Friday, May 17, 2024
Homeছোট গল্পপ্রতিমা - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রতিমা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়। আকাশের মেঘে বর্ষার সে ঘনঘোর রূপ আর নাই। মেঘের রঙ ফিরিতে আরম্ভ হইয়াছে, রৌদ্রের রঙেও পরিবর্তন দেখা দিয়াছে। গত বৎসরের অনাবৃষ্টি ও অজন্মার পর এবার বর্ষা হইয়াছে ভালো, মাঠে ধানের রঙ কষকষে কালো, আর ঝাড়ে গোছেও সুন্দর পরিপুষ্ট। দেশে একটা প্রশান্ত ভাব। গৃহস্থ-বাড়িতে পূজার কাজ পড়িয়া গিয়াছে, মাটির গোলা গুলিয়া ঘর নিকানোর কাজটাই প্রথমে আরম্ভ হইয়াছে, ওইটাই হইল মোটা কাজ এবং হাঙ্গামার কাজ। তাহার পর খড়ি ও গিরিমাটি দিয়া দুয়ারের মাথায় আলপনা দেওয়া আছে, খই-মুড়ি ভাজা আছে, মুড়কি-নাড়ুর ভিয়ান আছে। পূজায় কাজের কি অন্ত আছে!

চাটুজ্জে-বাড়ির গিন্নী বলেন, মা, ও মেয়ের হল দশ হাত, তারপর সঙ্গে আছে মেয়ে ছেলে সাঙ্গোপাঙ্গ, আমার দুহাতে উয্যুগ করে কি কুলিয়ে উঠতে পারি?

আজ চাটুজ্জে-বাড়িতে প্রথম মাটির ‘ছোপ’ পড়িবে। চণ্ডীমণ্ডপে কারিগর আসিয়া গিয়াছে, প্রতিমাতে আজ প্রথম মাটি পড়িবে।

বালতিতে করিয়া রাঙা মাটি গোলা হইয়াছে। বাড়ির বউ এবং ঝিউড়ি মেয়েরা গাছকোমর বাঁধিয়া হাতে সোনার অলঙ্কারের উপর ন্যাকড়া জড়াইয়া বসিয়া আছে, প্রতিমাতে মাটি পড়িলে হয়!

গিন্নী বলিলেন, ওরে, যা তো কেউ, দেখে আয় তো দেরি কত? ছেলেগুলো সব গেল কোথায়?

একটি মেয়ে বলিল, সব গিয়ে ঠাকুর-বাড়িতে বসে আছে।

সত্যই, সব ছেলে তখন চণ্ডীমণ্ডপে ভিড় জমাইয়া বসিয়াছিল। বুড়া মিস্ত্রী কুমারীশ তখন লম্ভঝম্ভ করিয়া চৌকিদারের সঙ্গে বকাবকি করিতেছিল, বলি, তোর বিত্তিগুলো আমাকে দিবি? তোর কাজ আমি করব কেন শুনি?

চৌকিদার কালাচাঁদ বলিল, ওই দেখ, আগ কর কেন গো? উ মাটি আনতে গেলে কেউ দেয় নাকি? বলে, গাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দেবে না?

—বলি, রাত্তিরে হাঁক দিতে বেরিয়ে নুকিয়ে খানিকটে আনতে পার নাই? না, হাঁকই দাও নাই রাত্তিরে?

—ওই দেখ, কী বলে দেখ, হাঁক না দিলে হয়? একবার করে তো বেরুতেই হয়। তা তুমি যে আজ আসবে, তা কী করে জানব বল? ভুল হয়ে গেইছে।

চাটুজ্জে-গিন্নী বাহিরের দরজায় দাঁড়াইয়া বলিলেন, অ কুমারীশ, বলি, হল তোমার? মেয়েরা যে গোলা গুলে বসে আছে গো! আর বকাবকি—

শীর্ণ খর্বাকৃতি মানুষ কুমারীশ, হাত-পাগুলি পুতুল-নাচের পুতুলের মতো সরু এবং তেমনই দ্রুত ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে নড়ে। আর চলেও সে তেমনই খরগতিতে। কুমারীশ, গিন্নীমায়ের কথা শেষ হইবার পূর্বেই, তারস্বরে চিৎকার করিয়া আরম্ভ করিল, আর বলেন কেন মা, কালাচাঁদকে নিয়ে আমি আর কাজ করতে পারব না, কোনো উয্যুগ নাই, মাথা নাই, মুণ্ডু নাই, হাত নাই, পা নাই—আমি আর কী করব বলুন?

বলিতে বলিতেই সে গিন্নীমায়ের নিকটে আসিয়া গড় হইয়া একটি প্রণাম করিয়া একেবারে প্রশান্ত কণ্ঠস্বরে বলিল, তারপরে ভালো আছেন মা? ছেলেপিলেরা সব ভালো? বাবুরা সব ভালো আছেন? দিদিরা বউমারা, সব ভালো আছেন?

গিন্নীমা হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, সব ভালো আছে। তোমার বাড়ির সব ছেলেপিলে—

কথা কাড়িয়া বলা কুমারীশের অভ্যাস, সে আক্ষেপপূর্ণ কণ্ঠে আরম্ভ করিল, আর বলেন কেন মা, হাম, পেটের অসুখ, জ্বর—সব ‘পইলট্ট’ খেলছে মা। ডাক্তার-বদ্যিতে ফকির করে দিলে।

তারপর আবার অত্যন্ত প্রশান্তভাবে সে বলিল, শুনলাম, ছোটবাবু এসেছেন ফিরে—বড় আনন্দ হল। তা এইবার বউমাকে নিয়ে আসুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেমানুষ, বুদ্ধির দোষে একটা—তা সব ঠিক হয়ে যাবে।

গিন্নীমা সমস্ত প্রসঙ্গটা চাপা দিয়া বলিলেন, তোমার আর দেরি কীসের শুনি? বউরা মেয়েরা গোলা দিয়ে চান করবেই বা কখন, খাবেই বা কখন?

কুমারীশ বলিল, আর দেরি কী! সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, কেবল এই বেশ্যের আগনের মাটি লাগে কিনা, তাই—

সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর তাহার পঞ্চমে উঠিয়া গেল, তাই শুধুন কেনে ওই বেটা বাউড়ীকে যে, মাটি কই? বাবু ভুলে গিইছেন। এ আমি কী করি বলুন দেখি, যাই, আমি আবার দেখে নিয়ে আসি। হুঁ উয্যুগ নাই, আয়োজন নাই, আমারই হয়েছে এক মরণ—বলিয়া সে অত্যন্ত দ্রুতবেগে এবং অনুরূপ দ্রুতকণ্ঠে বকিতে বকিতে ওই মাটির সন্ধানে পথ ধরিল।—আমারই হয়েকে এক দায়, যাই, এখন কোথা পাই বেশ্যের বাড়ি, দেখি। হারামজাদা বাউড়ী বলে, গাল দেবে! আরে, গাল দেবে কেন? কই আমাকে গাল দেয় না কেন? যত সব—! দক্ষিণে তো সেই মামুলি বারো টাকা, বারো টাকায় কি মাথা কিনে নিয়েছে আমার? পারব না, জবাব দিয়ে দেব। অঃ, খাতির কীসের রে বাপু?

গণ্ডগ্রাম হইলেও পল্লীগ্রাম, এখানে শহর বাজারের মতো প্রকাশ্যভাবে ব্যবসায় অবলম্বন করিয়া কোনো রূপোপজীবিনী বাস করে না, তবে নিম্নশ্রেণীর জাতির মধ্যে কলঙ্কিনীর অভাব নাই। গ্রামের পূর্ব-উত্তর কোণাংশে ডোমপল্লী,—এই ডোমেদের পুরুষেরা করে চুরি, মেয়েরা করে দেহ লইয়া বেসাতি। মা-বাপ লইয়া সংসারের গৃহাচ্ছাদনের আবরণ দিয়া প্রকাশ্যেই তাহারা সব করিয়া থাকে। কুমারীশ এই ডোমপল্লীতে প্রবেশ করিয়া ডাকিল, বলি, কই গো সব, দিদিরা সব কই, গেলি কোথা গো সব?

অদূরে একটা গাছতলায় চার-পাঁচটি মেয়ে জটলা করিয়া বসিয়া হি-হি করিয়া হাসিয়া এ উহার গায়ে ঢলিয়া পড়িতেছিল। কুমারীশের কণ্ঠস্বরে, ধ্বনিতে সকলে চকিত হইয়া ফিরিয়া চাহিল।

একজন বলিয়া উঠিল, ওলো, সেই পোড়ারমুখো আইচে লো, সেই মিস্ত্রী, মাটি নিতে আইচে মুখপোড়া—বলিতে বলিতে সে হাসিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে অপর সকলেও উচ্ছ্বসিত কৌতুকে হাসিয়া একটা মত্ত কলরোল তুলিয়া দিল।

—এই যে, এই যে সব বসে রয়েছিস। তারপর সব ভালো আছিস তো দিদিরা? রঙ নিয়ে আসিস, যাস সব, যাস। এবার ভাদু কেমন গড়ে দিয়েছিলাম, তা বল?

কুমারীশ এক মুঠা মাটি সংগ্রহ করিয়া লইয়াই তাহাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

একটা মেয়ে কৃত্রিম রাগ দেখাইয়া বলিয়া উঠিল, মাটি নিতে আইচ বুঝি তুমি? কেনে, কেনে লিবে, শুনি?

—লে লে, কেড়ে লে মুখপোড়ার হাত হতে। লে, কেড়ে লে।

কুমারীশ একরূপ ছুটিয়াই পথে নামিয়া অত্যন্ত খরবেগে চলিতে আরম্ভ করিয়া বলিল, প্রতিমে হবে দিদি, প্রতিমে হবে। যেও, যেও সব, রঙ দেব, তুলি দেব, যেও সব, পদ্ম আঁকবে দোরে।

মেয়েরা আবার হাসিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল।

একজন বলিল, ধর ধর বুড়োকে ধর।

একজন বলিল, সবাইকে রঙ দিতে হবে কিন্তুক।

কুমারীশ চলিতে চলিতেই ঘন ঘন ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই রঙ দেবার সময়, সেই—

সে একটা বাঁকের মুখে অদৃশ্য হইয়া গেল।

চাটুজ্জে-বাড়িতে মেয়েরা হুলুধ্বনি দিয়া গোলা দেওয়া আরম্ভ করিল। মেয়েদের মধ্যে সে এক আনন্দের খেলা। গোলা দেওয়ার নাম করিয়া এ উহাকে কাদা মাখাইবে, নিজেও ইচ্ছা করিয়া মাখিবে। বেলা দুই প্রহর, আড়াই প্রহর পর্যন্ত কাদা-মাখামাখি করিয়া ঘাটে গিয়া মাথা ঘষিয়া জল তোলপাড় করিয়া তবে ফিরিবে। সমস্ত বৎসরের মধ্যে তাহাদের এ একটা পরম প্রত্যাশিত উৎসব।

বাড়ির বড়মেয়ে একটা টুলের উপর দাঁড়াইয়া গোলার প্রথম ছোপটা দেওয়ালে টানিয়া দিবার সঙ্গে সঙ্গে মেজমেয়ে বড়-ভ্রাতৃজায়ার গায়ে কাদা ছিটাইয়া দিয়া বলিল, তোমার মুখে গোলা দিয়ে নিকুতে হবে আগে—তুমি বাড়ির বড়বউ।

বড়বউ কিন্তু প্রতিশোধে মেজ-ননদের গায়ে কাদা দিল না; সে বড়-ননদের গায়ে গোলা ছিটাইয়া দিয়া বলিল, তারপর বাড়ির বড়মেয়ে!

বড়মেয়ে হাতের কাদা-গোলা ন্যাকড়ার ন্যাতাটা থপ করিয়া মেজ-বউয়ের মুখের উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল, তারপর আমাদের মেজ-গিন্নী!

মেজবউ টুলের উপর বড়-ননদের দিকে মুখ করিয়া মুখখানি বেশ উঁচু করিয়াই ছিল, ন্যাকড়ার ন্যাতাটা থপ করিয়া আসিয়া তাহার মুখের উপর যেন সাঁটিয়া বসিয়া গেল। পরম কৌতুকে সকলে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

ঠিক এই সময়েই একটি সুন্দরী তরুণী আসিয়া কাদাগোলা লইয়া মেজ-ননদের গায়ে ছিটাইয়া দিয়া বলিল, তোমায় কেউ দেয়নি বুঝি?

মেয়েদের হাসি-কলরোল থামিয়া গেল, পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া সকলে যেন বিব্রত হইয়া উঠিল।

মেয়েটি বলিল, আমাকে বুঝি ডাকতে নেই বড়দি? আমি বলে কত সাধ করে বসে আছি!

বড়বউ বলিল, ছোটবউ, তুমি ভাই মাকে জিজ্ঞেস করে কাদায় হাত দাও।

মাকে জিজ্ঞাসা করিতে হইল না; চাটুজ্জে-গিন্নী নিজেই আসিয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি ছোটবউকে সেইখানে দেখিয়া বলিলেন, তুমি কাদায় হাত দিও না বউমা। অমূল্য দেখলে অনত্থ করবে মা, কেলেঙ্কারীর আর বাকী রাখবে না। তুমি সরে এস।

ছোটবউয়ের মুখখানি ম্লান হইয়া গেল, সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সরিয়া আসিয়া একপাশে দাঁড়াইয়া রহিল। মেয়েদের কলরবের উচ্ছ্বাসে পূর্বেই ভাঁটা পড়িয়াছিল, তাহারা এবার কাজ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। বড়মেয়ে অত্যন্ত বিরক্তিভরে বলিল, সেই থেকে একটা বই ন্যাতা দেওয়ালে উঠল না! নে নে, ন্যাতা দে না, অ বড়বউ!

ঠিক এই সময়েই কুমারীশ চিৎকার করিতে করিতে আসিয়া বলিল, টুল নাই, মোড়া নাই, আমি কি তালগাছে চড়ে মাটি দেব? কই, গিন্নীমা কই? একটা টুল চাই যে মা, একটা টুল না হলে—আমি তো এই দেড়হাত মানুষ!

বাড়ির চারিপাশ অনুসন্ধান করিয়া গিন্নীমা বলিলেন, আর একটা টুল আবার গেল কোথা? তুমি জান বড়বউমা?

কুমারীশ বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে ছোটবউয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, এ বউটি কে গিন্নীমা?

গিন্নীমা বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ছোটবউমা, তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছ মা? ছি, বার বার বলে তোমাকে পারলাম না। যাও, ওপরে যাও।

ছোটবউ ঘোমটাটা টানিয়া দিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল! কুমারীশ বলিল, ইনিই আমাদের ছোটবউমা? আহা-হা, এ যে সাক্ষাৎ দুগগা-ঠাকরুন গো, অ্যাঁ, এমন চেহারা তো আমি দেখি নাই? আহা-হা! অ্যাঁ, এমন লক্ষ্মী ঘরে থাকতে ছোটবাবু আমাদের, অ্যাঁ—ছি ছি ছি!

গিন্নীমা অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, কুমারীশ, তুমি এসেছ প্রতিমে গড়তে, তোমার ওসব কথায় কাজ কি বাপু? ও বড়বউমা, টুল আর একটা গেল কোথায়?

কুমারীশ বার বার ঘাড় নাড়িয়া অপরাধ স্বীকার করিয়া বলিল, তা বটে, আপনি ঠিক বলেছেন। হ্যাঁ, তা বটে, আমাদের ও কথায় কাজ কি? হ্যাঁ, তা বটে; তা আপনি ভাববেন না—সব ঠিক হয়ে যাবে। আহা-হা, এমন মুখ তো আমি—

বাধা দিয়া গিন্নীমা বলিলেন, তুমি যাও কুমারীশ, আমি টুল পাঠিয়ে দিচ্ছি। দাঁড়িয়ে গল্প কর না, যাও, আপনার কাজ কর গে।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এই যে—আমার বলে কত কাজ পড়ে আছে, সাতাশখানা প্রতিমে নিয়েছি। আমার বলে মরবার অবসর নাই।

কুমারীশ যে উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়াছিল, আহা, এ যে সাক্ষাৎ দুগগা-ঠাকরুন গো!—সে কথাটা অতিরঞ্জন নয়। তবে উচ্ছ্বাসটা হয়তো অশোভন হইয়াছিল। চাটুজ্জে-বাড়ির ছোটবধূটি সত্যই অতি সুন্দরী মেয়ে। সকলের চেয়ে সুন্দর তাহার মুখশ্রী। বড় বড় চোখ, বাঁশির মতো নাক, নিটোল দুইটি গাল, ছোট্ট কপালখানি। কিন্তু চিবুকের গঠন-ভঙ্গিটিই সর্বোত্তম, ওই চিবুকটিই মুখখানিকে অপরূপ শোভন করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু এত রূপের অন্তরালে লুকানো ছিল মেয়েটির দগ্ধ ললাট। তাহার এমন শুভ্র স্বচ্ছ রূপের অন্তরালে নির্মল জলতলের পঙ্কস্তরের মতো সে ললাট যেন চোখে দেখা যাইত।

পাঁচ বৎসর পূর্বে, ছোটবধূ যমুনার বয়স তখন বারো, সে তখন সবে বাল্যজীবনের অনাবৃত সবুজ খেলার মাঠ হইতে কৈশোরের কুঞ্জবনে প্রবেশ করিয়াছে, তখনই তাহার এ বাড়ির ছোটছেলে অমূল্যের সহিত বিবাহ হয়। অমূল্যর বয়স তখন চব্বিশ। বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল, খানিকটা জমিদারী আছে, তাহার উপর মায়ের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, সুতরাং তাহার স্বেচ্ছাচারী হইবার পক্ষে কোনো বাধা ছিল না। সকাল হইতে সে কুস্তি, মগুর, লাঠি লইয়া কাটাইয়া খানদশেক রুটি অথবা পরোটা খাইয়া বাহির হইত স্নানে। পথে সাহাদের দোকানে খানিকটা খাঁটি গিলিয়া স্নানান্তে বাড়ি ফিরিত বেলা দুইটায়। তারপর আহার ও নিদ্রা। সন্ধ্যায় আবার বাহির হইয়া ফিরিত বারোটায় অথবা আরো খানিকটা পরে, তখন সে আর বাড়ির দুয়ার খুঁজিয়া পাইত না। মা তাহার জাগিয়া বসিয়া থাকিতেন। গ্রামেও তাহার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত ছিল না, আজ ইহাকে প্রহার, কাল তাহার মাথা ফাটাইয়া দেওয়া, কোনোদিন বা কাহারও গৃহে অনধিকার-প্রবেশ প্রভৃতি নানা ধরনের বহু অভিযোগ। এই সময়েই প্রথম পক্ষ বিয়োগের পর খুঁজিয়া পাতিয়া এই সুন্দরী যমুনার সহিত তাহার বিবাহ হইল। কিন্তু ফুলশয্যার রাত্রেই সে যমুনাকে নির্মমভাবে প্রহার করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। কয়দিন পরই গেল গঙ্গাস্নান করিতে। সেখানে এক যাত্রিনীর উপর পাশবিক অত্যাচার করার জন্য অত্যাচারীকে হত্যা করার অপরাধে তাহার কয় বৎসর জেল হইয়া যায়। তারপর এই মাসখানেক পূর্বে অমূল্য বাড়ি ফিরিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে যমুনাকেও আনা হইয়াছে। পাঁচবৎসর পূর্বে সেদিন এজন্য চাটুজ্জে-বাড়ির মাথাটা লজ্জায় মাটিতে নত হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে লজ্জা বেশ সহিয়া গিয়াছে; মাটিতে যে মাথা ঠেকিয়াছিল, সে আবার ধীরে ধীরে উঠিয়াছে। এখন অমূল্যকে লইয়া শুধু অশান্তি আর আশঙ্কা। অশান্তি সহ্য হয়, কিন্তু আশঙ্কার উদ্বেগ অসহনীয়, পাছে সে আবার কিছু করিয়া বসে, এই আশঙ্কাতেই সকলে সারা হইয়া গেল। সকলে আশঙ্কা করিয়াই খালাস, কিন্তু সে আশঙ্কা নিবারণের দায়িত্ব ওই বধূটির উপর আসিয়া পড়িয়াছে। তাই বধূটির প্রতি সতর্কবাণীর অন্ত নাই, অহরহ তাহাকে সকলে সে কথা স্মরণ করাইয়া দেয়, যমুনা ভয়ে ঠকঠক করিয়া কাঁপে।

কুমারীশ রাত্রেও প্রতিমার গায়ে মাটি ধরাইতেছিল, তাহার ভাইপো যোগেশ হারিকেনের লণ্ঠনটি উঁচু করিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কুমারীশ প্রতিমার গায়ে মাটি দিতে দিতেও ভাবিতেছিল ওই বধূটির কথা। মেয়েটিকে তাহার বড় ভালো লাগিয়াছে। আহা, এমন সুন্দর মেয়ে, আর তাহার স্বামী কিনা এমন! সে এ বাড়িতে বহুদিন প্রতিমা গড়িতেছে, ওই ছোটবাবুকে সে ছোট ছেলেটি দেখিয়াছে। এইখানেই সে এমনই করিয়া প্রতিমাতে মাটি দিত, আর ছোট ছেলেটি বলিত, দেবে না, মিস্ত্রী দেবে না?

সে বলিত, দেব গো, দেব।

—কবে দেবে?

—কাল।

—না, আজই দাও, ও মিস্ত্রী!

—হ্যাঁ বাবু, এই ঠাকুর তো তোমার, আবার কাত্তিক দিয়ে কী হবে?

—না, আমায় কাত্তিক গড়ে দাও।

সে হাসিয়া বলিত, বাবু আমাদের ক্ষ্যাপা বাবু।

সেই ছেলে এমন হইয়া গেল! গেল গেল, কিন্তু এমন সুন্দর মেয়ে—! মিস্ত্রীর চোখের সম্মুখে প্রতিমার মুখখানি যেন জ্বলজ্বল করিতেছে। সে স্থির করিল, ছোটবাবুর সঙ্গে দেখা হইলে হয়, সে তাহাকে বেশ করিয়া বলিবে।

যোগেশ বলিল, কাকা, রাত হল অনেক, আজ আর থাকুক।

কুমারীশ অত্যন্ত চটিয়া উঠিল, থাকুক! কালও একবেলা এইখানেই কাটুক, না কি? বলি প্রতিমে সাতাশখানা, তা মনে আছে?

যোগেশ ক্লান্তভাবে বলিল, তা হোক কেনে। ওই দেখ, চৌকিদার হাঁক দিচ্ছে।

হাতের কাদার তালটা থপ করিয়া ফেলিয়া দিয়া কুমারীশ বলিল, ওই নে, ওই নে। মরগা যেয়ে তারা, দেখে নিগে, বুঝে নিগে সব, আমি আর কিছু পারব না।

সে উঠিয়া আসিয়া বালতির জলে হাত ডুবাইয়া খল খল করিয়া ধুইতে আরম্ভ করিল।

—অপ অপ, অ্যাও, অপ!

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া শব্দ উঠিতেছিল, দৃপ্ত এবং উচ্চ কণ্ঠে শাসনবাক্য ধ্বনিত হইতেছে। কুমারীশ অকস্মাৎ অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল, বলিল, তাই তো রে, চৌকিদারই বটে। উঃ, খুব বলেছিল বাবা! রাত অনেক হয়েছে রে! হুঁ, রাত একেবারে সনসন করছে! নে, একবার তামুক সাজ দেখি।

যোগেশ তামাক সাজিতে বসিল।

—অপ অপ কোন হ্যায়? অ্যাও উল্লুক!

কুমারীশ চমকিয়া উঠিল। লণ্ঠনের আলোকে সভয়ে দেখিল, অসুরের মতো দৃঢ় শক্তিশালী এক জোয়ান সম্মুখে দাঁড়াইয়া। চোখ দুইটা অস্থির, পা টলিতেছে, হাতের শক্ত বাঁশের লাঠিগাছটা মাটিতে ঠুকিয়া সে প্রশ্ন করিতেছে, অ্যাও উল্লুক!

মুহূর্তে সে চিনিল, চাটুজ্জে-বাড়ির ছোটবাবু। কিন্তু তাহার সে মূর্তি দেখিয়া ভয়ে তাহার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। সে অতি ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া বলিল, ছোটবাবু, পেনাম, ভালো আছেন?

লণ্ঠন, প্রতিমা, মাটি এবং কুমারীশকে একসঙ্গে দেখিয়া ছোটবাবুর মনে পড়িল। সে বলিল, মিস্তিরী, তুমি মিস্তিরী?

কৃতার্থ হইয়া কুমারীশ বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, কুমারীশ মিস্ত্রী।

লণ্ঠনের আলোটা তুলিয়া ধরিয়া বেশ করিয়া কুমারীশকে দেখিয়া বলিল, A sly fox met a hen–Sly fox মানে খ্যাঁকশেয়ালী। মাটি দিচ্ছ, বেশ, মা জগদম্বা, মাগো মা!

মিস্ত্রী তাহাকে খুশি করিবার জন্যই আবার বলিল, শরীর ভালো আছে ছোটবাবু?

—শরীর, নশ্বর শরীর। Iron man—লোহার শরীর। দেখ, দেখ।—বলিয়া সে এবার তাহার ব্যায়ামপুষ্ট দৃঢ়পেশী একখানা হাত বাহির করিয়া মুঠি বাঁধিয়া আরও শক্ত করিয়া মিস্ত্রীর সম্মুখে ধরিল।

—দেখ, টিপে দেখ।—অপ!

মিস্ত্রী সভয়ে শিহরিয়া উঠিল। অমূল্য নিজের হাতের লাঠিটা প্রসারিত হাতখানায় আঘাত করিয়া বলিল—টমটম চালা দেগা—টমটম। এই পেতে দিলাম হাত, চালিয়ে দাও টমটম।

কুমারীশ অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ওদিকে পুকুরটার পাড়ে বাঁশবনে বাতাসের বেগে বাঁশগুলি দুলিয়া পরস্পরের সহিত ঘর্ষণ করিয়া শব্দ তুলিতেছিল, ক্যাঁ-ক্যাঁ—ক্যাঁট-ক্যাঁট। নানাপ্রকার শব্দ।

অমূল্য লাফ দিয়া হাঁকিয়া উঠিল, অপ! কোন হ্যায়? অ্যাও!

বাঁশবনের শব্দ থামিল না, বায়ুপ্রবাহ তখনও সমানভাবে বহিতেছিল অমূল্য হাতের লাঠিগাছটা আস্ফালন করিয়া বলিল, ভূত।

মিস্ত্রী বলিল, আজ্ঞে না, বাঁশ।

—আলবৎ ভূত, কিংবা ছেনাল লোক ইশারা করছে।

তারপর অত্যন্ত আস্তে সে বলিল, সব খারাপ হয়ে গিয়েছে। সব চরিত্র খারাপ। ওই শালা যদো, যদো শালা বাঁশী বাজায়, শালা কেষ্টো হবে! শালা, মারে ডাণ্ডা।

বাতাসের প্রবাহটা প্রবলতর হইয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের শব্দও বিচিত্রতর এবং উচ্চতর হইয়া বাজিতে আরম্ভ করিল। অমূল্য ক্ষিপ্ত হইয়া লাঠিখানা লইয়া সেইদিকে চলিল, অপ অপ অপ, আমাকে ভয় দেখাও শালা? শালা ভূত, আও আও, চলা আও—অপ!

মিস্ত্রী অবাক হইয়া অমূল্যকেই দেখিতেছিল। সহসা সে এক সময় ঊর্ধ্বলোকে, বোধ করি, দেবতার উদ্দেশেই দৃষ্টি তুলিতে গিয়া দেখিল, শূন্যলোকের অন্ধকারের মধ্যে আলোকের দীর্ঘ ধারা ভাসিতেছে। সে দেখিল, সম্মুখেই চাটুজ্জেবাড়ির কোঠার জানালায় আলো জ্বালিয়া জানালার শিক ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছোট-বধূটি; আলোকচ্ছটায় তাহাকে যে কেহ দেখিতে পাইবে, সে খেয়াল বোধ করি তাহার নাই। সে উপরে আলোক-শিখা জ্বালিয়া নিচে অমূল্যর সন্ধান করিতেছে। কুমারীশ বিষণ্ণ অথচ বিমুগ্ধ যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। —অপ অপ—আও আও আও—অপ। —বলিয়া হাঁক মারিতে মারিতে ঠাকঠক শব্দে বাঁশের উপর লাঠি দিয়া আঘাত আরম্ভ করিল।

যোগেশ আসিয়া কুমারীশের হাতে হুঁকাটি দিয়া বলিল, চল, টানতে টানতেই চল বাপু। যে মশা, বাবা, এ যেন চাক ভেঙ্গেছে! গা-হাত-পা ফুলে উঠল।

কুমারীশ চকিত হইয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ওগো, বউমা, গিন্নী-মাকে ডেকে দাও বরং, ও কি!

অত্যন্ত ক্ষিপ্রবেগে আলোটা সরিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে জানালাটাও বন্ধ হইয়া গেল।

কুমারীশ বলিল, ওগো, ও ছোটবাবু! ও ছোটবাবু!

ছোটবাবুর কানে সে কথার শব্দ প্রবেশই করিল না, সে তখনও সমানে বাঁশবনের সহিত যুদ্ধ করিতেছে।

যমুনার জীবন নিজের কাছে যে কতখানি অসহনীয়—সে যমুনাই জানে, কিন্তু তাহার বহি:প্রকাশ দেখিয়া কিছু বোঝা যায় না। শরতের চঞ্চল চাঁদের মতো তখনই তাহার মুখ মেঘে ঢাকিয়া যায়, আবার তখনই সে উজ্জ্বল চাঞ্চল্যে হাসিয়া উঠে।

কিন্তু কুমারীশ মিস্ত্রীর তাহার জন্য বেদনার সীমা রহিল না। সে মনে মনে ‘হায় হায়’ করিয়া সারা হইল। দিন বিশেক পরে প্রতিমাতে ‘দু মৃত্তিকা’ অর্থাৎ তুষ মাটির উপরে কালো মাটি ও ন্যাকড়ার প্রলেপ লাগাইয়া, মুখ বসাইয়া, হাতে পায়ে আঙুল জুড়িয়া মাটির কাজ সারিবার জন্য কুমারীশ আসিয়া হাজির হইল। চাটুজ্জে-বাড়িতে তখন পূজার কাজ লইয়া ব্যস্ততার আর সীমা ছিল না। মুড়ি-ভাজার কাজ তখন আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। পূজার কয়দিনের খরচ আছে, তাহার উপর বিজয়া-দশমীর ও একাদশীর দিনের খরচ একটা প্রকাণ্ড খরচ,—অন্ততঃ পাঁচশত লোক আসিয়া আঁচল পাতিয়া দাঁড়াইবে। বড়বউ, বড়মেয়ে, মেজবউ প্রকাণ্ড বড় বড় ধামায় মুড়ি ভরিয়া ঘরের মধ্যে তুলিতেছে। মেজমেয়ে ভাঁড়ারের হাঁড়িগুলি বাহির করিয়া ঝাড়িয়া মুছিয়া আবার তুলিয়া রাখিতেছে, নূতন মসলাপাতি ভাণ্ডারজাত হইবে। ছোটবধূটিকে পর্যন্ত কাজে লাগানো হইয়াছে, সে বারান্দার এক কোণে বসিয়া সুপারি কাটিতেছে।

কুমারীশ প্রতিমার গায়ে লাগাইবার জন্য পুরানো কাপড়ের জন্য আসিয়া উঠানে দাঁড়াইয়া কলরব করিতে আরম্ভ করিল, কই, গিন্নীমা গেলেন কোথায়? এ কী বিপদ দেখ দেখি! গিন্নীমা গেলেন কোথা গো? ও গিন্নীমা!

মুড়ির ধামাটা কাঁখে করিয়া যাইতে যাইতে বড়বউ বলিল, না বাপু, মিস্ত্রী দেখছি বাড়ি মাথায় করলে। তোমার কি আস্তে কথা হয় না নাকি?

বড়মেয়ে বলিল, মিস্ত্রী আমাদের পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসে কি না, ঘোড়া দাঁড়ায় না।

কুমারীশ ঈষৎ লজ্জিত হইয়া বলিল, দিদি-ঠাকরুন বলেছেন বেশ। ওটা আমার অভ্যেস। আমার শাশুড়ী কী বলত জানেন? বলত, কুমারীশকে নিয়ে পরামর্শ করা বিপদ, পরামর্শ করবে তো লোকে মনে করবে, কুমারীশ আমার ঝগড়া করছে।

বড়বউ অল্প হাসিয়া বলিল, তা যেন হল। এখন কী চাই বল দেখি তোমার?

পাচিকা পাঁচুদাসী বলিল, চেঁচিয়ে গাঁ মাথায় করে কুমারীশ।

কুমারীশ অত্যন্ত চটিয়া গেল, তোমার ঠাকরুন, বড় ট্যাঁকটেকে কথা। না চেঁচালে এ বাড়িতে জিনিস পাওয়া যায়? পুরানো কাপড় চাই, তা ঠাকরুনরা জানে না নাকি? আমার তো বাপু, এক জায়গায় বসে হাঁড়ি ঠেলা নয়। সাতাশখানা—

বাধা দিয়া বড়বউ বলিল, সব ঠিক করে রেখেছি বাবা, গোছানো, পাট করা সব ঠিক হয়ে আছে!

তারপর চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিল, কাকেই বা বলি! ও ছোটবউ, দাও তো ভাই, ওই কাঠের সিন্দুকের ওপর ভাঁজ করা আছে এক পুঁটলি কাপড়।

কুমারীশ তাড়াতাড়ি বড়বধূর নিকট আসিয়া চুপিচুপি কহিল, বড়বউমা, ছোটবাবু এখনও তেমনিই রাত করে আসে?

বড়বধূ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া তাহার দিকে চাহিতেই অর্ধপথে সে নীরব হইয়া গেল।

বড়বধূ বলিল—কেন বল তো?

—এই—না, বলি, ঘরথাই হল নাকি, মানে ছোটবউমা আমাদের সোনার পুতুল। আহা মা, চোখে জল আসে আমার।

বড়বউ চুপিচুপি বলিল, আমাকে যা বললে বেশ করলে, কিন্তু ও কথা আর কাউকে শুধিও না মিস্ত্রী। মা শুনলে রাগ করবেন, ছোটবাবু শুনলে তো রক্ষা থাকবে না।—বলিয়াই সে খালি ধামাটা সেইখানেই নামাইয়া নিজেই কাপড় আনিতে অগ্রসর হইল। ইতোমধ্যে ছোটবউই কাপড়ের পুঁটলিটা বাহির করিয়া আনিয়া দাঁড়াইল। বড়বউ তাহার হাত হইতে পুঁটলিটা লইয়া কুমারীশের হাতে দিয়া বলিল, আর যদি লাগে তো মার কাছে এসে চাইবে, আমরা আর দিতে-টিতে পারব না।

ছোটবউ মৃদুস্বরে বলিল, আমাকে মেজদিদির মতো একটা হাতি গড়ে দিতে বল না দিদি।

কুমারীশ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, সে তো আমি দিয়েছি মেজদিদিমণিকে। দেব, দেব, দুটো হাতি গড়ে এনে দেব। হাতির ওপর মাহুত সুদ্ধু।

বড়বউ বলিল, ছোটবউ, তুমি ঘরের ভেতর যাও। কুমারীশ, যাও বাবা, কাপড় তো পেলে, এইবার যাও।

কুমারীশ কাপড়ের পুঁটলিটা বগলে করিয়া বাহির হইয়া গেল। চণ্ডীমণ্ডপে তখন ছেলের দল এমন ভিড় জমাইয়া তুলিয়াছে যে, যোগেশ এবং আর একজন অত্যন্ত বিব্রত হইয়া উঠিয়াছে। কে একজন মহিষের মুণ্ডুটা তুলিয়া লইয়া পলাইয়াছে। কুমারীশ পিছন হইতে বলিল, মাটি করলে রে বাবা, মাটি করলে! কই কই, বিষকাদা কই, দে দে, সব লাগিয়ে দে! ধর ধর, যোগেশ, ধর সব।

বিষকাদাকে ছেলেদের বড় ভয়, বিষকাদা গায়ে লাগিলে নাকি ঘা হয়। আর, আর যে বিশ্রী গন্ধ! ছেলের দল ছুটিয়া সরিয়া গেল। কুমারীশ একটা মোটা তুলিতে গোবর ও মাটির তরল গোলা তুলিয়া ছিটাইতে ছিটাইতে বলিল, পালা সব, পালা এখন। সেই হয়ে গেলে আসবি সব।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার একটি দুইটি করিয়া জমিতে আরম্ভ করিল।

কুমারীশ একজনকে বলিল, কই, তামুক আন দেখি খানিক।

রাত্রে জানালার উপর আলোটি রাখিয়া যমুনা একা বসিয়াছিল! সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। পূজার কাজে সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া যে যাহার ঘরে শুইয়া পড়িয়াছে। বোধহয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। একা ঘরে যমুনার শুইতে বড় ভয় করে। অমূল্য মদ খাইয়া ভীষণ মূর্তিতে আসিলেও সে আশ্বস্ত হয়, মানুষের সাড়া পাইয়া শুইবামাত্র ঘুমাইয়া পড়ে। অমূল্যের অত্যাচার প্রায় তাহার সহিয়া আসিয়াছে। অমূল্যের প্রহারের চেয়ে আদরকে তাহার প্রথম প্রথম বেশি ভয় হইত, সেও তাহার সহিয়া গিয়াছে। কিন্তু রাত্রির প্রথম দিকের এই নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাহার ভয়ের আর অন্ত থাকে না। কেবল মনে হয়, যদি ভূত আসে! ঘরের দরজা জানালা সমস্ত বন্ধ করিয়া প্রাণপণে চোখ বুজিয়া সে পড়িয়া থাকে, ঘরের মধ্যে আলোটা দপদপ করিয়া জ্বালিয়া দেয়।

আজ চণ্ডীমণ্ডপে মিস্ত্রীরা প্রতিমা গড়িতেছে, খানিকটা দূরেও জাগ্রত মানুষের আশ্বাসে সে জানালা খুলিয়া তাহাদের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে। লাগিতেছেও বেশ। উহারা গুজগুজ করিয়া কথা কহিতেছে; কাজ করিতেছে; একজন ছোট মিস্ত্রী কাঠের পিঁড়ার উপর মাটির নেচি দ্রুত পাক দিয়া লম্বা লম্বা আঙুলগুলি গড়িতেছে, একজন ছাঁচে ফেলিয়া মাটির গয়না গড়িতেছে, আর কুমারীশ প্রতিমার মুখগুলি গড়িতেছে। বাঁশের পাতলা টুকরা দিয়া নিপুণ ক্ষিপ্রতার সহিত ভ্রূ চোখ মাটির তালের উপর ফুটাইয়া তুলিতেছে। ইহার পর মুখের উপর গঙ্গামাটির প্রলেপ দিয়া মাজিবে। যমুনা ছেলেবেলায় কত দেখিয়াছে। সিমেণ্ট করা মেঝের মতো পালিশ হইবে।

—বউমা, জেগে রয়েছেন মা?

যমুনা চকিত হইয়া উঠিল। মাথার ঘোমটাটা টানিয়া দিয়া সে একটু পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। নিজেই একটু জিব কাটিল, মিস্ত্রী দেখিয়া ফেলিয়াছে।

—আমি খুব ভালো হাতি গড়ে এনে দেব একজোড়া। দুটো মাটির বেরাকেটও এনে দেব। তারই ওপর রেখে দেবেন।

যমুনা সসঙ্কোচে আবার আসিয়া জানালায় দাঁড়াইল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলিল, ব্রাকেট দুটোর নীচে দুটো পরী গড়ে দিও, যেন তারাই মাথায় করে ধরে ধরে আছে।

কুমারীশ বলিল, না, দুটো পাখি করে দেব? পাখি উড়ছে, তারই পাখার ওপর বেরাকেট থাকবে।

যমুনা ভাবিতে বসিল, কোনটা ভালো হইবে!

কুমারীশ নীরবে কাজ করিতে আরম্ভ করিল, কয়েক মিনিট পরেই আবার সে বলিল, আর দুটো ঘোড়াও গড়ে এনে দেব বউমা।

যমুনা পুলকিত হইয়া বলিল, না, তার চেয়ে বরং দুটো চিংড়িমাছ গড়ে দিও।

এবার সে ঘোমটা সরাইয়া ফেলিল। যে গরম!

—চিংড়িমাছ? আচ্ছা, ঘোড়াও আনব, চিংড়িমাছও আনব। কিন্তু শিরোপা দিতে হবে মা।

যমুনার মুখ ম্লান হইয়া গেল, সে তাড়াতাড়ি বলিল, তুমি দুটো হাতিই এনে দিও শুধু।

—কেন মা, শিরোপার কথা শুনে ভয় পেলে নাকি? সব এনে দেব মা, একখানি তোমার পুরানো কাপড় দিও শুধু। আর কিছু লাগবে না।

অন্ধকার নিষুতি রাত্রে ধীরে ধীরে ভীত তরুণী বধূটির সহিত মিস্ত্রীর এক সহৃদয় আত্মীয়তা গড়িয়া উঠিতেছিল—ওই দেবী-প্রতিমাটির মতোই।

—অপ অপ, চলে আও, বাপকে বেটা হোয় তো চলে আও!

অমূল্য হাসিতেছে। ভীত হইয়া মিস্ত্রী উপরের দিকে চাহিয়া বধূটিকে সাবধান করিতে গিয়া দেখিল, অত্যন্ত সন্তর্পণে জানালাটি বন্ধ হইয়া আসিতেছে। সে আপন মনে কাজ করিতে বসিল।

—অ্যাই মিস্ত্রী!

—ছোটবাবু, পেনাম।

—ওই শালা রমনা, শালা পেসিডেনবাবু হইছে, শালা। শালা, মারব এক ঘুঁষি, শালা ট্যাক্সো লিবে। শালা ফিস্টি করে খাচ্ছে পাঁঠা মাছ পোলাও, শালা। হাম দেখে লেঙ্গে।

কুমারীশ চুপ করিয়া রহিল।

আজ সটান বাড়ির দরজায় গিয়া অমূল্য বদ্ধ দ্বারে লাথি মারিয়া ডাকিল, অ্যাও, কোন হ্যায়? খোল কেয়াড়ি।

কিছুক্ষণ পরই যমুনার অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি শোনা যায়। অমূল্য মারে এবং শাসন করে, চোপ, চোপ বলছি, চোপ। পূজার দিন চারেক পূর্বে কুমারীশ আবার আসিয়া প্রতিমায় রঙ লাগাইয়া দিয়া গেল। যমুনার আনন্দের আর সীমা রহিল না; কুমারীশ একটা প্রকাণ্ড ডালায় করিয়া ব্রাকেট, হাতি, ঘোড়া চিংড়িমাছ, এক জোড়া টিয়াপাখি পর্যন্ত আনিয়া তাহাকে দিয়া গিয়াছে।

মা কিন্তু মুখভার করিয়া বলিলেন—অমূল্যকে না বলে এই সব কেন বাপু? তা এখন দাম কী নেবে বল?

কুমারীশ পুলকিত হইয়া বলিল, দাম? এর আবার দাম লাগে নাকি মা? দেখুন দেখি। আমারও তো বউমা উনি—

বড়মেয়ে হাসিয়া বলিল, সুন্দর মানুষকেই সবাই সব দেয়, আমরা কালো মানুষ—

কুমারীশ প্রচণ্ড কলরব করিয়া উঠিল, আপনাকেও এনে দেব দিদিমণি। দেখুন দেখি, দেখুন দেখি, আপনি হলেন বড়দিদি।

সে দ্রুতপদে পলাইয়া গেল।

মা আবার বলিলেন, অমূল্যকে বল না যেন বউমা, যে মানুষ!

রাত্রে সেদিনও যমুনা জানালায় বসিয়া মিস্ত্রীকে বলিল, ভারি সুন্দর হয়েছে মিস্ত্রী, ভারি সুন্দর!

উচ্ছ্বসিত কুমারীশ বলিল, পছন্দ হয়েছে মা?

যমুনা পুলকিত মুখে আবার ঘাড় নাড়িয়া বলিল, খুব, খুব পছন্দ হয়েছে। হাতি দুটো মেজদির চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।

—তুমি একটু বস মা, আমি চক্ষুদানটা করে আসি। লক্ষ্মীর হয়েছে, সরস্বতীর হয়েছে, এইবার ঠাকরুনের চোখ মা।

যমুনা ঐ স্থানটির দিকেই চাহিয়া বসিয়া রহিল।

—অ্যাও, কোন হ্যায়? চুরি—চুরি করেগা? ছেনালি করেগা? শালা, মারেগা ডাণ্ডা, অপ অপ!

কোনো কল্পিত ব্যক্তিকে শাসন করিতে করিতে আজ একটু সকালেই অমূল্য আসিয়া উপস্থিত হইল।

মা নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু যমুনা তাহাকে খেলনাগুলি না দেখাইয়া পারিল না। তাহার অন্তরও ছিল পুলকিত, তাহার উপর আজ অমূল্য আসিয়া তাহাকে আদর করিয়া বুকে টানিয়া লইল। যমুনা উচ্ছ্বসিত আনন্দে ডালার কাপড়খানা খুলিয়া তাহাকে পুতুলগুলি দেখাইয়া বলিল, কেমন বল দেখি? খুব সুন্দর নয়?

চিংড়িমাছটা তুলিয়া ধরিয়া অমূল্য বলিল, গলদা হ্যায়, মারেগা কামড়?

যমুনা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

ঘোড়াটা দেখিয়া অমূল্য বলিল, কেয়াবাৎ রে পক্ষিরাজ—চিঁ হিঁ হিঁ!

যমুনা বলিল, মিস্ত্রী আমাকে এনে দিয়েছে।

—মিস্তিরী—sly fox—ওই খ্যাঁকশেয়ালী? অ্যাই মিস্তিরী!—সঙ্গে সঙ্গে সে জানালাটা খুলিয়া বলিল, গুড ম্যান, the sly fox is a good man, আচ্ছা আদমী!

সেই সঙ্গেই আবার জানালাটা বন্ধ করিয়া দিয়া যমুনাকে কাছে টানিয়া লইল।

লজ্জায় আক্ষেপে আশঙ্কায় মায়ের অবস্থাটা হইল অবর্ণনীয়। দারুণ লজ্জায় চণ্ডীমণ্ডপে সমবেত প্রতিবেশীদের সম্মুখে আর মাথা তুলিয়া কথা কহিতে পারিলেন না। কোনোরূপে দেবকার্য শেষ করিয়া পলাইয়া আসিয়া বাঁচিলেন; কিন্তু বাড়িতেও তখন মৃদু গুঞ্জনে ওই আলোচনাই চলিতেছিল। বড়মেয়ে গালে হাত দিয়া ফিসফিস করিয়া বলিতেছিল, বড়বউ দুই চোখ বিস্ফারিত করিয়া শুনিতেছিল।

মা জোড়হাত করিয়া বলিলেন, তোমাদের পায়ে পড়ি মা, ও কথা আর ঘেঁটো না। ছি ছি ছি রে! আমার কপাল!

বড়বউ বলিল, আমরা চুপ করলে আর কী হবে মা, পাড়াপড়শী তো গা টেপাটেপি করছে!

বড়মেয়ে বলিল, মেয়েমানুষের যার রূপ থাকে, তাকে একটুকুন সাবধানে থাকতেও হয়, বাড়ির গিন্নীকেও সাবধানে রাখতে হয়। রামায়ণ পড়, মহাভারত পড়—

বাধা দিয়া মা বলিলেন, দোহাই মা, চুপ কর, তোমাদের পায়ে ধরছি। অমূল্য শুনলে আর রক্ষে থাকবে না।

ছোটবধূটি তখন উপরে বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে আয়নাখানার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভয়ে ঠক ঠক করিয়া কাঁপিতেছিল। মিথ্যা তো নয়, দেবী-প্রতিমার মুখে যে তাহারই মুখের প্রতিবিম্ব।

মেয়ে-মহলে সেই কথারই আলোচনা চলিতেছে। প্রতিচ্ছবি এত সুস্পষ্ট যে, কাহারও চোখ এড়ায় নাই।

দেবতার কাছে অপরাধ, মানুষের কাছে অপরাধ, অপরাধের বোঝা যমুনার মাথায় পাহাড়ের মতো চাপিয়া বসিয়াছে। তাহার উপর তাহার স্বামী! ভয়ে সে থর থর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল।

কিন্তু যমুনার ভাগ্য ভালো যে, অমূল্য পূজার কয়দিন বাড়িমুখোই হইল না। গ্রামে পূজা-বাড়িগুলির বলিদানের খবরদারি করিতেই তাহার কাটিয়া গেল। হাড়িকাঠে পাঁঠা লাগাইলে সে ঘাড়টা সোজা করিয়া দেয়; খানিকটা ঘি ডলিয়া একটা থাপ্পড় মারিয়া বলে, লাগাও—অপ!

বলিদান হইলে ঢাকী ও ঢুলীদের মধ্যে লাঠি লইয়া পাঁয়তারা নাচ নাচে। রাত্রে কোনোদিন লোকজনে ধরাধরি করিয়া তুলিয়া লইয়া আসে, কোনোদিন কোথায় পড়িয়া থাকে, তাহার ঠিকানা কেহ জানিতে পারে না।

বিজয়া-দশমীর দিন কিন্তু কথাটা তাহার কানে উঠিল। কানে উঠিল নয়, সে সেদিন স্বচক্ষেই দেখিল। গ্রামেও সেদিন এই আলোচনাটা ওই ঢাক-ঢোলের বাদ্যের মতোই প্রবল হইয়া উঠিল।

চাটুজ্জে-বাড়ির বাউড়ী ঝি মাঝপথ হইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ওগো মা, দাদাবাবু আজ ক্ষেপে গেইছে! লাঠি নিয়ে সে যা করছে আর বলছে, আমার বউয়ের মতো অ্যাঁ—, আর অপ অপ করছে।

বাড়িসুদ্ধ শিহরিয়া উঠিলেন। সমস্ত বাড়িতে যেন একটা আতঙ্কের ছায়া নামিয়া আসিল। অমূল্যর এই কয়দিনের অনুপস্থিতিতে ও চৈতন্যহীনতার অবকাশে যমুনা খানিকটা সুস্থ হইয়াছিল, কিন্তু আজ আবার সেই আতঙ্কের আকস্মিক আগমন-সম্ভাবনায় সে দিশেহারার মতো খুঁজিতেছিল—পরিত্রাণের পথ। তাহার উপর সমস্ত গ্রামটা নাকি তাহার কথা লইয়া মুখর! এ লজ্জা সে রাখিবে কোথায়? আপনার ঘরে সে লুকাইয়া গিয়া বসিল দুইটা বাক্সের আড়ালের মধ্যে। নীচে বাড়ির মধ্যে ওই আলোচনাই চলিতেছে। পাশের বাড়িতেও ওই কথা। খোলা জানালাটা দিয়া যমুনা স্পষ্ট শুনিতে পাইল, ছি ছি ছি!

কিছুক্ষণ পরই অমূল্য ফিরিল নাচিতে নাচিতে।—অপ অপ! মা কই, মা, পেনাম করি, আচ্ছা বউ করেছ মা, ফাস্ট, চাকলার মধ্যে ফাস্ট! দুগগা-মায়ের মুখ ঠিক বউয়ের মতো মা! দুগগা-প্রতিমে! অ্যাই ছোটবউ, অ্যাই? কই ছোটবউ!

কিন্তু কোথায় ছোটবউ? সমস্ত বাড়ির মধ্যে ছোটবউয়ের সন্ধান মিলিল না। সমস্ত রাত্রি অমূল্য পাগলের মতো চিৎকার করিয়া ফিরিল।

পরদিন চণ্ডীমণ্ডপে পূজার খরচের জন্য রাজ্যের লোক আসিয়া জমিতেছিল। সকলে বৃত্তি পাইবে। নানা বৃত্তি—কাপড়, পিলসুজ, ঘড়া, গামছা, পূজার যত কিছু সামগ্রী, মায় নৈবেদ্য পর্যন্ত বৃত্তি বিলি হইবে। কুমারীশও এই গ্রামের মুখে আসিতেছিল, তাহার পাওনা অনেক। পরনে তাহার নতুন লালপেড়ে কোরা কাপড়, গলায় কোরা চাদর, বগলে ছাতা, হাতে একটা পুঁটলিতে বাঁধা কয়টি মাটির পুতুল ও খেলনা। সে হন হন করিয়া গ্রামে প্রবেশ করিল।

প্রতিমা-বাহকেরা জল হইতে দেবী-প্রতিমার খড়ের ঠাট তুলিয়া আনিয়া চণ্ডীমণ্ডপে নামাইয়া দিয়া বিদায়ের জন্য দাঁড়াইল। তাহারা চাহিল, মা, বেসজ্জনের বিদেয় আমাদের—মুড়কি-নাড়ু!

ঠিক এই সময়েই বাড়ির ঝি-টা দেখিল, বাড়ির খিড়কির ঘাটেই যমুনার দেহ ভাসিতেছে। তাড়াতাড়ি তোলা হইল—বিবর্ণ শবদেহ। অমূল্য আছাড় খাইয়া কাঁদিয়া পড়িল।

কুমারীশ বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া বজ্রাহতের মতো দাঁড়াইয়া গেল।

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments