Friday, May 17, 2024
Homeভৌতিক গল্পহনলুলুর জাদুকরি - সুধীন্দ্রনাথ রাহা

হনলুলুর জাদুকরি – সুধীন্দ্রনাথ রাহা

হনুলুলু যাব, এমন প্রত্যাশা কোনোদিন করিনি। কেন যাব? ইউরোপ থেকে বহু— বহু দূরে। সানফ্রান্সিসকো থেকেও দীর্ঘদিনের পথ। কী করতে যাব সেখানে?

কিন্তু গেলাম একদিন। গিয়ে সেইসব জিনিসই দেখলাম, ওখানে যা দেখবার প্রত্যাশা করিনি। দেখলাম, পুরোদস্তুর পাশ্চাত্য শহর একটি, যার রাস্তায় রাস্তায় দু-খানা বাড়ি বাদে বাদেই একটা করে ব্যাঙ্ক। আর চারখানা বাড়ি বাদে বাদেই একটা করে জাহাজ কোম্পানির অফিস। সেই পিচঢালা চওড়া রাস্তায় ফোর্ড, বুইক, প্যাকার্ড গাড়ির মিছিল, সেই প্রাসাদপুরীর পিছনেই খোলার বস্তি, সেই বন্দর এলাকায় হোটেলে হোটেলে দুনিয়ার যাবতীয় দেশের নাবিকের সমাগম। হইহল্লা, মদ আর মেয়ে নিয়ে বেলেল্লাপনা— এসব তো বাড়ি বসেই দেখতে পাওয়া যেত! দেখেছিও বাড়িতে বসেই। এর জন্যে হনুলুলু কেন আসতে হবে?

এক বন্ধু দিয়েছিলেন পরিচয়পত্র, উইন্টার নামে এক ভদ্রলোকের নামে। বয়স হবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, মাথায় চুল বড়ো একটা নেই, তবে যে ক-টা আছে, তাদের রং এখনও কালো। মুখখানা সরুপানা, নাকমুখ চোখা-চোখা। প্রকাণ্ড শেল-চশমার দরুন একটু গাম্ভীর্য আসবার কথা ছিল সে-মুখে, কিন্তু চশমার আড়াল থেকে দু-টি চক্ষু এমন পিটপিট করছে সারাক্ষণ যে তা দেখলেই হাসি পায়। লম্বাই বলতে হবে লোকটিকে, একান্ত একহারা চেহারা। হনুলুলুতেই জন্ম, বাপের ছিল মস্ত দোকান, হোসিয়ারির এবং আরও কী কী সব জিনিসের, যা শৌখিন ধনীদের হামেশাই দরকার হয়।

ব্যাবসাতে পয়সা ছিল, কিন্তু ভূতে কিলোলে মানুষের যা হয়, তাই হয়েছিল উইন্টারের। ‘ওসব আমার দ্বারা হবে না’— বলে বাপকে করে দিল গুডমর্নিং, তারপর নিউইয়র্কে গিয়ে ভরতি হল থিয়েটারে। বিশ বছর সেখানে কাটা সৈনিক এবং ঝাড়নধারী ভৃত্য সাজল পরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে। তারপর, সম্ভবত কিলোতে কিলোতে ভূতেরা শ্রান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছিল বলেই, ধুত্তোর বলে সে ফিরে এল হনুলুলুতে, বাপের ব্যাবসা তখনও বজায় আছে, ঢুকে পড়ল তাইতে। বেশ আছে সেই থেকে, গলফের মাঠ ঘেঁষেই মস্ত বাড়ি তার, সে-বাড়ির সামনে মোতায়েন মস্ত গাড়ি তার, সেই গাড়িতে আমায় চড়িয়ে সে বেরিয়ে পড়ল শহর দেখাতে। একটা জমকালো অট্টালিকা দেখিয়ে বলল, ‘ওই হল স্টাবসদের বাড়ি’।

‘কী করেন স্টাবসরা?’

‘কী আর করবেন? ঠাকুরদা এদেশে এসেছিলেন মিশনারি হয়ে, পয়সা করে গিয়েছেন অঢেল। শুনলে অবাক হবেন, হনুলুলুর যাবতীয় বড়োলোকই, হয় কোনো ভূতপূর্ব মিশনারির ছেলে, নয়তো ভূতপূর্ব মিশনারির নাতি। এদেশে তখন ছিল কানাকা রাজা, সে রাজার জ্ঞানবুদ্ধি না-থাকুক, কৃতজ্ঞতা ছিল। বহু দূরের দেশ থেকে সাদা মিশনারি এসেছে কানাকা জাতকে অন্ধকার থেকে আলোকে পৌঁছে দেবার জন্য, তাদের যথোচিত পুরস্কার না-দিলে চলে কখনো? এক-একজন মিশনারিকে বলতে গেলে এক-একটা রাজ্যখণ্ড লিখে দিয়েছিল রাজা। এখন সে রাজার বংশধরেরা পথের ফকির, মিশনারির বংশধরেরা ধনকুবের।’

হঠাৎ উইন্টার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাল, তারপর হাত তুলে কানের কাছে ধরল ঘড়িটা, তারপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘যাঃ, বন্ধ হয়ে গিয়েছে! আমার একটা রীতি আছে, ঘড়ি বন্ধ হলেই আমি ককটেল খাই একটা। আপত্তি আছে আপনার?’

‘না, আপত্তি আর কী!’

‘ইউনিয়ন সেলুনে যাননি বোধ হয়? চলুন, দেখিয়ে আনি।’

নামটা আগেই শোনা ছিল— ওই ইউনিয়ন সেলুনের। বিখ্যাত জায়গা ওটা হনুলুলুর। একটা কানা গলির ভিতরে। একেবারে শেষ মাথায়। কানা গলি বটে, তাহলেও প্রশস্ত আর পরিচ্ছন্ন। দু-ধারে সারি সারি অফিস। তাতে করে সেলুনের খরিদ্দারদেরই সুবিধে হয়েছে খুব। যাচ্ছি সেলুনে, লোকে ভাবছে কোন অফিসে যাচ্ছি বিষয়কর্ম উপলক্ষ্যে। সুবিধে নয়?

সেলুনের ঘরটা বিশাল। এ মাথা থেকে ও মাথা টানা কাউন্টার। দুই কোণে দুটো ঘেরা খুপরি। জনশ্রুতি— কানাকাদের রাজা কালাকুয়া যখন বেঁচে ছিলেন, এখানে এসে মদ খেতেন ওই খুপরিতে বসে। কাউন্টারে ভিড় করেছে যে প্রজারা, তারা টেরও পেত না যে, পঙক্তিভোজনে যোগ না-দিলেও তাদের রাজা বিলিতি অমৃতের পুরো বখরা নিচ্ছেন চুপিসাড়ে।

সেলুনে সোনা-বাঁধানো ফ্রেমে কালাকুয়ার ছবি ঝুলছে একখানা। তার উলটো দিকে ঝুলছে রানি ভিক্টোরিয়ারও। হঠাৎ মনে হল, সেলুনটা এখনও কালাকুয়া-ভিক্টোরিয়ার যুগেই রয়ে গিয়েছে। অদূরে ওই মোটর ঘর্ঘরে মুখর রাজপথে যে যুগের আবহাওয়া বইছে, এখানকার আবহাওয়া তার চাইতে দুই পুরুষ আগেকার। লোক গিজগিজ করছে সেলুনে। তাদের চালচলনে আধুনিক যুগের বাস্তব-সচেতনতা কমই দেখছি। সবাইয়ের চোখ যেন প্রায় আধবোজা, যেন জনে জনে এক-একটা মূর্তিমান লোটাস ইটার, ‘ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে’।

গিজগিজ করছে লোক। উইন্টার তাদের অর্ধেককেই চেনে দেখছি। একজন তো নাম ধরেই হাঁক দিল, ‘আরে, এদিকে এসো হে, অনেক দিন তোমার সঙ্গে গেলাস ঠোকাঠুকি হয়নি।’

তাকিয়ে দেখলাম— বেঁটে মোটা চশমা-পরা একটা লোক। একা দাঁড়িয়েই গেলাসের প্রতীক্ষা করছে। উইন্টার এদিকে বলছে, ‘খরচা কিন্তু আমার ক্যাপ্টেন!’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আসুন, ক্যাপ্টেন বাটলারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই আপনার।’ করলাম ক্যাপ্টেনের সঙ্গে করমর্দন, কথাও কইলাম দুই-একটা কিন্তু আমার মনোযোগ পড়েছিল গোটা ভিড়টার উপরে, বিশেষ করে ক্যাপ্টেনকে আলাদা লক্ষ করার কথা মনে হয়নি।

মোটরে উঠে উইন্টার বলল, ‘বাটলারের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে গেল, ভালোই হল। লোকটিকে কেমন লাগল?’

‘কেমন আবার লাগবে? ভালো করে লক্ষই করিনি—’

উইন্টার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি অনৈসর্গিক ব্যাপারে বিশ্বাস করেন?’

একটু হাসলাম, ‘খুব যে করি, তা নয়।’

‘বছর দুই আগে বাটলারের জীবনে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। শুনবেন ঘটনাটা তার মুখ থেকে?’

‘কীরকম ব্যাপার?’

সোজা উত্তর না-দিয়ে আবোলতাবোল জবাব দিল উইন্টার, ‘বলে বোঝানো শক্ত। কিন্তু ঘটনাগুলো ঠিকই ঘটেছিল। আগ্রহ আছে ওসবে?’

‘কোন সবে?’

‘মন্তর-তন্তর— জাদু—’

‘এমন লোক একজনও দেখিনি আমি, ওসবে যার আগ্রহ নেই—’

উইন্টার ভাবল একটুখানি— তারপর বলল, ‘আমার মুখ থেকে আপনার না-শোনাই ভালো। চলুন, সন্ধ্যা বেলায় আপনাকে বাটলারের স্টিমারে নিয়ে যাই। কোনো কাজের ক্ষতি হবে না তো আপনার?’

‘কাজ আমার কিছু নেই আজ সন্ধ্যা বেলায়—’

স্টিমারেতেই বাটলারকে খবর দিল উইন্টার। সন্ধ্যায় জেটিতে গিয়ে দেখি, বাটলার ডিঙি পাঠিয়েছে আমাদের স্টিমারে নিয়ে যাবার জন্য। একটু দূরেই নোঙর করা আছে জলযানটা, বলতে গেলে বন্দর এলাকার শেষপ্রান্তে একেবারে। ডিঙিতে যেতে যেতে বাটলারের ইতিহাস খানিকটা আমায় শোনাল উইন্টার। লোকটা প্রশান্ত মহাসাগরেই জীবন কাটিয়েছে। আগে ছিল ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলের যাত্রী স্টিমারের ক্যাপ্টেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় একবার, স্টিমার ডুবি হয়ে মারা যায় অনেক যাত্রী। তাইতে ও চাকরি চলে যায় বাটলারের। তারপর থেকে ও কাজ করছে এক চীনা মহাজনের স্টিমারে। ক্যাপ্টেন পদই পেয়েছে, তবে সার্টিফিকেট বাতিল হয়ে গিয়েছিল বলে মাইনে নিতে হচ্ছে কম। এখন ও স্টিমার নিয়ে হনুলুলু অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে মাল চালাচালি করে, হেডকোয়ার্টার হনুলুলুতেই।

উইন্টারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ডিঙি এসে স্টিমারের গায়ে লাগল। আমরা উঠে গেলাম ঝোলানো মই দিয়ে। উঠতে উঠতেই শুনতে পেলাম ইউকুলিলের বাজনা— চার-তারওয়ালা গিটার একরকম। এ মুলুকে ওর প্রথম আমদানি করে পোর্তুগিজরা।

আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইউকুলিল বাজায় কে?’

‘দেখতেই পাবেন’— বলে হাসল উইন্টার।

পেলাম দেখতে। কেবিনে শুয়ে পড়ে আছে বাটলার, তার গায়ের উপর হেলান দিয়ে বসে গিটার বাজাচ্ছে এক সুন্দরী যুবতী, হাওয়াই অঞ্চলের মাপকাঠিতেই শুধু নয়, মেয়েটা যেকোনো দেশের মাপকাঠিতে সুন্দরী নাম পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।

আমাদের দেখে বাটলার কিছুমাত্র লজ্জা পেল না। উঠবার চেষ্টাও করল না। এমনকী, মেয়েটাকেও নড়ে বসতে বলল না একটু। পূর্বাবস্থা সম্পূর্ণ বজায় রেখেই ডাকল বাবুর্চিকে ‘কফি লাও’— বলে।

এস্থানে হঠাৎ সুন্দরী রমণী দেখে যত-না বিস্মিত হয়েছিলাম, তার চেয়ে চার গুণ বিস্মিত হতে হল একটা হতকুৎসিত চীনাকে কফি নিয়ে প্রবেশ করতে দেখে। সে যে কী বীভৎস মূর্তি একখানা, বর্ণনা করাই দুঃসাধ্য! অত্যন্ত বেঁটে, কিন্তু মজবুত খুব। খুঁড়িয়ে হাঁটে। পরনের প্যান্টালুন কোনো এক সময় সাদা ছিল বোধ হয়। এখন তা সাদা আর বাদামির মাঝের একটা রঙে দাঁড়িয়েছে, পোঁচের পরে পোঁচ ময়লা জমে জমে। মুখখানা চৌকো, নাক নেই, ফুটো দুটো আছে। সবার উপরে চেকনাই বেরিয়েছে ঠোঁটে। উপর ঠোঁট কাটা, সোনায় সোহাগা, এই মূর্তিমান এ্যাপোলোটি গন্নাকাটা আবার।

কফি রেখে এই চলমান বিভীষিকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল যখন, সত্যি বলতে কী, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার। তখন কফি খেতে খেতে বাটলার শুরু করল তার গল্প। সেই গল্প শুনতেই যে আমার আগমন, তা আগেই নিশ্চয় তাকে বলে রেখেছিল উইন্টার।

যে-ভাষার গল্পটা এখানে লিপিবদ্ধ হচ্ছে, পাঠক-পাঠিকা যেন ভাববেন না যে— সেটা বাটলারেরই ভাষা। যে-জবান তার শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল, তা যেমন ব্যাকরণ দোষে কণ্টকিত, তেমনই শ্লীলতাবর্জিত। আদিরসাত্মক বুকনি না-দিয়ে একটাও বাক্য গঠনের শক্তি তার আছে বলে আমার তো মনে হয়নি। না, ভাষা তার নয়, তার কাছ থেকে যা পেয়েছিলাম তা একটা শুকনো কাঠামো মাত্র, তার উপর প্রতিমা রচনা এবং অলংকরণ যা-কিছু, তার সব দায়িত্ব বহন করতে হয়েছে এই অধমকেই।

কথাটা তাহলে এই—

নানা দ্বীপে ঘুরে বেড়ায় বাটলার, একটা দ্বীপে আলাপ হল স্থানীয় এক কানাকা চাষির সঙ্গে। বাটলারকে সে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। সেখানে বাটলারকে আলাপ করিয়ে দিল নিজের মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটি যুবতী, সুন্দরী। আলাপ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, মেয়েটা বেচে দেওয়া বাটলারের কাছে। বাটলার এককথায় রাজি, কারণ রূপ ও যৌবন দুটোই আছে মেয়েটার।

দাম ঠিক করে, নগদ মূল্য বাপকে বুঝিয়ে দিয়ে, মেয়েটিকে নিয়ে স্টিমারে এসে উঠল বাটলার। পা যেন তার আর পাটাতন স্পর্শ করছে না, সে যেন হাওয়ায় উড়ছে, এই পরিকে অঙ্কশায়িনী করতে পেরে। মেয়েটাও সত্যিই দারুণ মজে গিয়েছে। তার ভাবে-ভঙ্গিতে বাটলার নিঃসন্দেহ হল যে, পিয়ারি তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছে, দারুণরকমে ভালোবেসেছে।

স্টিমারের জীবন যেন স্বর্গসুখে পূর্ণ হয়ে উঠল বাটলারের পক্ষে।

সে কি তখন জানত যে, এ-স্বর্গে শয়তান ঢুকেছে মেটমূর্তি ধারণ করে?

মেটটা ওই দেশেরই লোক, যদিও নিজের নাম সে নিজেই রেখেছে হুইলার। কিন্তু হুইলার বলে তাকে ডাকে না কেউ, তাকে ব্যানানাস বলে। ব্যানানাস, যার সরলার্থ কলার কাঁদি। কী করে যে এমন অদ্ভুত নাম জুটে গেল ওর ভাগ্যে, তা বলতে পারে না কেউ। ও নিজে হয়তো জানে, কিন্তু বলে না কাউকে।

লম্বা-চওড়া লোক এই ব্যানানাস, যৌবন আর নেই দেহে, কিন্তু দেহ এখনও যথেষ্ট সামর্থ্য। অত্যন্ত গোমড়ামুখো লোক, তাতে চোখ ট্যারা হওয়ার দরুন ওর গোটা চেহারাটাতেই একটা শয়তানি ছাপ পড়েছে পাকাপোক্তভাবে। কিন্তু এক গুণে সে বাটলারের প্রিয়, লোকটা দক্ষ নাবিক।

এখন হয়েছে কী একদিন, স্টিমার বেঁধে রয়েছে একটা ছোটো দ্বীপের বন্দরে, ক্যাপ্টেন উঠেছে ডাঙায়। ফেরবার কথা যখন, ফিরল তার দুই ঘণ্টা আগে, কারণ যে কাজে গিয়েছিল, পৌঁছোবার পরে দেখল যে, সেদিন তা হওয়ার কোনো আশা নেই।

দুই ঘণ্টা আগে ফিরল, স্টিমারে উঠে দেখল— এক তাজ্জব ব্যাপার। কেবিনের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরে থেকে সেই দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে ক্যাপ্টেন, আর চিল্লাচ্ছে, ‘খোল বেটি খোল, নইলে খুন করব তোকে!’

আরও তাজ্জব! কেবিনের ধারে কাছে একটাও লোক নেই।

ক্যাপ্টেনের বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। দেয়ালের একটা বিশেষ জায়গায় হাঙরের চামড়ার চাবুক ঝোলানো থাকে বরাবর, সেইটে টেনে নিয়ে সে বজ্রনাদে ডাকল ‘ব্যানানাস—’

সঙ্গেসঙ্গে ব্যানানাস ফিরে দাঁড়াল, আর ঝড়াক করে দরজা খুলে ক্যাপ্টেনের পিয়ারি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্যাপ্টেনের বুকে, ‘ব্যানানাস আমায়— আমায়—’

আর বলতে হল না, হাঙরের চামড়ার চাবুক একেবারে দুই ফাঁক করে চিরে ফেলল ব্যানানাসের মুখখানা— একটি আঘাতেই।

ব্যানানাসকে কিন্তু তাড়িয়ে দিল না বাটলার। যদিও পিয়ারি তাকে বার বার বলেছিল তাড়িয়ে দিতে, ‘ওকে রাখলে ভয়ানক ক্ষতি করবে ও। এদেশের লোক তুকতাক অনেক জানে। আমি এদেশের মেয়ে, আমি দেখেছি— সে-সবের খ্যামতা।’

বাটলার কিন্তু কিছুতেই রাজি নয় ওকে ছাড়তে। ‘ওর মতো চৌকোস মেট আমি সহজে পাব না আর একটি। ধরো, আমার যদি দু-দিন অসুখই করে, কাজ চালাবে কে?’

ব্যানানাস রয়ে গেল, কাজ করতে থাকল। চাবুকের ঘটনাটা যেন সে ভুলেই গিয়েছে, ভাবখানা দেখাতে লাগল এইরকমই। তারপর, ওমার্সি দ্বীপে যখন স্টিমার ভিড়ল, একদিনের ছুটি নিয়ে ডাঙায় গেল, ‘এখানে আমার মামা থাকে, দেখে আসি একবার।’

মামার সঙ্গে দেখা করে ব্যানানাসও স্টিমারে এসে উঠল, বাটলারও অসুখে পড়ল। প্রথম প্রথম এমন বেশি কিছু না। চোখ জ্বালা করছে, খিদে নেই, রাতে ঘুম হলেও সকালে দেহটা লাগছে দারুণ অবসন্ন—

অসুখ এমন বেশি কিছু নয়, কিন্তু পিয়ারি এতেই ভয় পেয়ে গেল ভয়ানকরকম। ‘এখনও ব্যানানাসকে বিদায় দাও, ও তোমাকে জাদু করেছে, মেরে ফেলবে তোমাকে।’

বাটলার হেসে উড়িয়ে দেয়। ‘তোমাদের ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করলে কি ইংরেজ জাত পৃথিবী শাসন করতে পারত? এই তো যাচ্ছি হনুলুলুতে, ডাক্তার ডেনবিরের ওষুধ এক বোতল খেলেই সব অসুখবিসুখ বাপ বাপ করে পালাবে।’

ভিড়ল স্টিমার হনুলুলুতে, ডাকা হল ডাক্তার ডেনবিকে। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন নানারকমে, তারপর মুখটি চুন করে বললেন, ‘না হে ক্যাপ্টেন, তোমার দেহে অসুখ তো আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে। অথচ তুমি শুকিয়ে গিয়েছ, জীবনীশক্তি তোমার কমে গিয়েছে ভয়ানকরকম, তাও তো চোখেই দেখছি। এ অবস্থায় আমি যে কী বলব, তা তো বুঝতে পারছি নে। তুমি এক কাজ করবে? হাসপাতালে এসে থাকো দুই-তিন হপ্তা। তাহলে আমরা নানারকমভাবে পরীক্ষা করতে পারব তোমাকে, অসুখ যদি কিছু থাকে, ধরতে পারবই।’

এতে আবার নারাজ বাটলার। স্টিমার ছেড়ে হাসপাতালে গেলে, চীনে মালিক কি স্টিমার জেটিতে বেঁধে রাখবে? সে অন্য ক্যাপ্টেন ঠিক করে স্টিমার দরিয়ায় পাঠিয়ে দেবে পত্রপাঠ।

ডেনবি আর কী করবেন! কিছু ফল হবে না জেনেও ওষুধ লিখে দিলেন দুই-তিন রকম, তারপর বিদায় নিলেন মাথা নীচু করে।

স্টিমার আবার ভাসল দরিয়ায়। হপ্তাখানেকের মধ্যে বাটলার পৌঁছে গেল যমের বাড়ির দরজায়। স্টিমারসুদ্ধ লোক বুঝতে পেরেছে— ক্যাপ্টেনের আয়ু আর দুই-চার দিনের বেশি নয়।

আর স্টিমারসুদ্ধ লোক মুচকি হাসছে— এক অতি তাজ্জব ব্যাপার দেখে। ক্যাপ্টেনের অতি সাধের পিয়ারি, যার জন্য ব্যানানাসের মুখটা দুই ফাঁক হয়ে গিয়েছিল চাবুকের ঘায়ে, সেই পিয়ারি আজকাল দারুণ ন্যাওটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যানানাসের। ‘আখের গুছিয়ে নিচ্ছে বেটি’— বলাবলি করছে নাবিকেরা। ‘ক্যাপ্টেন মরলে ব্যানানাসই তো হবে ক্যাপ্টেন! অন্তত অস্থায়ীভাবে তো হবেই! এবারকার চক্কোর শেষ করে স্টিমার যখন হনুলুলুতে ফিরবে, নতুন ক্যাপ্টেন যদি বহাল হয়ই তো হবে তখন। ততদিন? ওই ব্যানানাসের ঘাড়ে ভর না-করে সুন্দরী যান কোথায়?’

বাস্তবিকই আজকাল ব্যানানাসকে উত্তরোত্তর বেশি বেশি আস্কারা দিয়ে যাচ্ছে পিয়ারি। অবশেষে একদিন নিরিবিলিতে ব্যানানাস যখন তাকে জাপটে ধরল, সে তিলার্ধ বাধা দিল না তাকে, উলটে হাত বাড়িয়ে গলাই জড়িয়ে ধরল তার। তারপর আর কী! সারারাত ব্যানানাসের অঙ্কে সে বিরাজ করল পরমানন্দে। ব্যানানাসের সঙ্গে বন্দোবস্ত তার পাকা। ক্যাপ্টেন মরলে ব্যানানাসই তো হচ্ছে ক্যাপ্টেন। পিয়ারি তখন ব্যানানাসেরই পিয়ারি হয়ে যাবে। থাকবে এই স্টিমারেই। কার কী বলার আছে তাতে? সে তো আর বাটলারের বিয়ে করা বউ নয়!

ব্যানাসাস মুগ্ধ, গদগদ।

রাত কাটল প্রেমানন্দে। ভোর বেলায় জানালা খুলে দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে পিয়ারি। আয়না নেই, জল আছে ক্যালাবাস-কুমড়োর খোলে। জল এখন স্থির, তাইতে মুখ দেখছে পিয়ারি, হঠাৎ বলে উঠল, ‘ও ভাই, ক্যালাবাসের ভিতর এটা চকচক করে কী?’

চকচক করে? সোনাদানা না কি? দেখবার জন্য উঠে এল ব্যানানাস, পিয়ারি সরে বসল, ব্যানানাস মুখ বাড়িয়ে দিল ক্যালাবাসের উপর। তার মুখের ছায়া পড়েছে জলে।

আর তক্ষুনি হঠাৎ হাতের এক ধাক্কায় ক্যালাবাসটা ভয়ানক নাড়িয়ে দিল পিয়ারি। জল উঠল ছলকে, ব্যানানাসের মুখের ছায়া চকিতে চুরচুর! আঁ-আঁ-আঁ করে একটা মরণ-আর্তনাদে ডুকরে উঠল ব্যানানাস, এক বার হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল পিয়ারির দিকে, কিন্তু হাত বাড়িয়ে তাকে ধরবার শক্তি আর তার হল না। বজ্রাহতের মতো সে লুটিয়ে পড়ল ক্যালাবাসের পাশে। দেহ তার নিষ্প্রাণ তখন।

পিয়ারি ছুটে গিয়েছে তখন বাটলারের কাছে। বাটলার তখন উঠে বসেছে বিছানায়, মুখে তার নবজীবনের আলো। ‘আমার যেন কোনো অসুখই নেই আর’— বলল সে।

‘থাকবে না অসুখ’— বলল পিয়ারি, ‘যে তোমাকে মেরে ফেলছিল, সে নিজেই মরেছে। হতভাগা জাদু শিখে এসেছিল মামার কাছ থেকে। কিন্তু মামা একথা তাকে বলে দেয়নি যে, স্থির জলে মুখের ছায়া যদি হঠাৎ ছিঁড়ে যায়, তাহলে হৃৎপিণ্ডটাও বুকের ভিতর ছিঁড়ে যায় তক্ষুনি। ও তা জানত না, কিন্তু আমি জানতাম। আমার পিসি ছিল জাদুকরি, কিছু কিছু আমায় শিখিয়েছিল সে। তোমায় শুধু একটি কাজ করতে হবে এখন, একটা গন্নাকাটা লোক সারাক্ষণ রাখতে হবে সমুখে। তাহলে কোনো জাদু আর স্পর্শ করবে না তোমায়।’

‘হনলুলু’, সোমারসেট মম অবলম্বনে …

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments