Friday, May 17, 2024
Homeভৌতিক গল্পচাঁদনি রাতে - মঞ্জিল সেন

চাঁদনি রাতে – মঞ্জিল সেন

দাদুকে ঘিরে বসেছে নাতিনাতনিরা, ‘গল্প বলো দাদু, ভূতের গল্প।’

‘সব্বোনাশ!’ দাদু আঁতকে ওঠেন। ‘বলিস কী! এই ভরসন্ধেয় ভূতের গল্প শুনতে নেই, রাত্তিরে ভয়ে ঘুম হবে না।’

‘কখনো না,’ সরবে প্রতিবাদ করে ওঠে বাচ্চার দল।

‘ভূতের গল্প তো সন্ধেবেলাই জমে দাদু,’ বলল টুটুল। ‘তা ছাড়া আমরা বড়ো হয়েছি না!’

‘বড়ো হয়েছ, তাই তো!’ দাদু ভালোমানুষের মতো বলেন, ‘কত বয়স হল তোমার দাদুভাই?’

‘কেন, আমি এবার বারোয় পড়ব না!’ টুটুল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে জবাব দিল।

‘আমি ওর থেকে মাত্তর এক বছরের ছোটো,’ বলে ওঠে কাকুন।

সবাই যে যার বয়স বলতে শুরু করে। কারু দশ, কারু নয়, কারু আট।

‘সত্যিই তো, তোমরা সবাই বড়ো হয়ে গেছ দেখছি,’ দাদুর দু-চোখে কৌতুকের হাসি। ‘এত বড়ো হয়ে গেছ আমি বুঝতেই পারিনি।’

‘তুমি বুড়ো হয়ে গেছ কিনা তাই কিছু মনে থাকে না তোমার,’ আট বছরের বাবলি রায় দিল।

‘নাও, এবার একটা ভালো ভূতের গল্প বলো।’

‘ভূতের গল্প, তার ওপর আবার ভালো!’ দাদু যেন একটু মুশকিলে পড়েন।

বাচ্চারা তাড়া দেয়।

‘আচ্ছা, শোনো তবে, ভয় পেলে আমাকে কিন্তু দুষতে পারবে না পরে।’

‘না, না,’ সমস্বরে বলে ওঠে বাচ্চার দল।

‘সে আজ অনেকদিন আগের কথা,’ দাদু মৌজ করে গড়গড়ার নলে কয়েকটা টান দিয়ে শুরু করলেন, ‘আমি তখন মাত্তর কলেজে ঢুকেছি। কত আর বয়েস, টুটুলের চাইতে পাঁচ-ছ বছরের বড়ো হব। তখন দিনকাল এত খারাপ ছিল না, জিনিসপত্তর অনেক সস্তা ছিল। তিন চার টাকায় এক মন চাল পাওয়া যেত।’

‘দাদু এমন বানিয়ে বলতে পারে!’ কাকুন বলে ওঠে। ‘আজই রঘু মাকে বলছিল চালের কেজি দশ টাকা হয়ে গেছে।’

দাদু হেসে বলেন, ‘না, দিদিভাই, আমাদের সময় চালের মন তিন চার টাকাই ছিল।’

‘আমরা কি চালের দামের গল্প শুনতে বসেছি?’ ঝংকার তুলল বাবলি।

‘আহা, আমি তো এখনও গল্পে আসিনি,’ মৃদু প্রতিবাদ করলেন দাদু। ‘তখন দিনকাল ভালো ছিল, জিনিসপত্তর পাওয়া যেত, লোকের অবস্থাও সচ্ছল, মানে জমিজমা, টাকাপয়সা ছিল। আর বুঝলে দাদু-দিদিভাইরা, এখনকার মতো চাকরিবাকরি পাবার পর তবে লোকে বিয়ে করত না। ছেলেরা একটা পাশ দিলেই মা-বাবা ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতেন। রোজগারের ভাবনা ছিল না তো! একজনের আয়ে গোটা সংসার চলে যেত। আমারও তাই বিয়ে হয়ে গেল— রাঙা টুকটুকে এক বউ।’

‘ওমা!’ বাবলি গালে হাত দিল। ‘দাদুর আবার রাঙা টুকটুকে বউ!’

‘আহা, দাদু কি চিরকালই বুড়ো ছিল নাকি?’ বিজ্ঞের মতো বলল টুটুল।

বাবলি সহজে হার মানবার পাত্রী নয়। বলল, ‘তবে কোথায় গেল দাদুর সেই বউ?’

‘কী বোকা মেয়ে!’ এবার বলে উঠল কাকুন। ‘দিমা-ই তো দাদুর বউ।’

‘ও-মা!’ বাবলির গলায় রাজ্যের বিস্ময়, ‘দিমা সেই রাঙা টুকটুকে বউ!’

‘তোদের জন্য আর ভূতের গল্প শোনা হবে না।’ একটু অধৈর্য গলায় বলল টুটুল। ‘দাদু, তুমি গল্প বলো।’

‘হ্যাঁ।’ গড়গড়ার নলে আবার কয়েকটা ঘন ঘন টান দিয়ে দাদু শুরু করলেন। ‘তোমাদের দিমার তখন কত-ই বা বয়স, এই কাকুনের মতো কি দু-এক বছর বেশি…’

‘ওমা!’ বাবলি আবার গালে হাত দিল। ‘অ্যাত্তটুকুন বয়সে দিমার বিয়ে হয়েছিল!’

‘হ্যাঁ, দিদিভাই,’ দাদু বাবলিকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তখন যে তাই নিয়ম ছিল।’

‘দাদু, ভূতের কথায় আসছ না কেন?’ তাড়া দিল টুটুল।

‘এই যে এবার আসছি,’ তাড়াতাড়ি বললেন দাদু। ‘বিয়ের পর তোমাদের দিমা বাপের বাড়ি থেকে গেলেন। ঠিক হল একবছর পর আমাদের বাড়ি আসবেন। আমি চলে গেলুম কলকাতায় কলেজে পড়তে। পুজোর ছুটির দিনকয়েক আগে আমি দেশের বাড়ি যাব। আমার শ্বশুরবাড়ি মানে তোমাদের দিমার বাপের বাড়ি পথেই পড়বে। আমি দিমার বাবার কাছে চিঠি লিখলুম যে আমি যাচ্ছি, দু-দিন ওখানে থেকে বাড়ি যাব।

‘দিমাদের ওখানে আমার পৌঁছুবার কথা সন্ধে সাতটায়, কিন্তু কপাল এমন খারাপ, ট্রেন চার ঘণ্টা দেরিতে স্টেশনে পৌঁছুল। স্টেশন থেকে আমার শ্বশুরবাড়ি পাক্কা পাঁচ মাইল। একটা গাড়িঘোড়াও চোখে পড়ল না যাতে চেপে যাব। তখনকার দিনে এমন মোটরগাড়ি কি সাইকেল রিকশা ছিল না তো। কী আর করি, হাঁটতে শুরু করলুম! অতক্ষণ ট্রেনে, তারপর এই হাঁটা, খিদে-তেষ্টায় প্রাণ যায় আর কি! ভাগ্যিস পূর্ণিমার রাত ছিল, অন্ধকারে খানা-ডোবায় পড়ার ভয় ছিল না।

‘হাঁটছি তো হাঁটছিই। পথ যেন আর ফুরোতে চায় না। পথে কোনো জনমনিষ্যি নেই। মফস্সল রাত ন-টার মধ্যেই সবাই শুয়ে পড়ে, তাই চারদিক নিঃঝুম; শুধু কানে ভেসে আসছে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক। হঠাৎ পাশেই মাঠ থেকে শেয়াল ডেকে উঠল, একটা দুটো নয়, চার-পাঁচটা। ভীষণ ভয় হল আমার! ওরা যদি আমাকে কামড়াতে আসে।

‘এতক্ষণ চাঁদের আলোয় বেশ দেখতে পাচ্ছিলুম, কিন্তু আকাশে কখন যে মেঘ জমতে শুরু করেছে খেয়াল করিনি। মাঝে মাঝে মেঘে ঢাকা পড়ছে চাঁদ, আর আকাশ থেকে যেন একটা কালো পর্দা নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। সেই অন্ধকারের বুক চিরে দপ দপ করে জ্বলে উঠছে আলেয়ার আলো, মাঝে মাঝে যেন এগিয়ে আসছে।

‘শ্বশুরবাড়ি যাবার আনন্দে ভয়ডরের কথা মনে আসেনি, এবার কিন্তু যত রাজ্যের ভয় আর চিন্তা আমাকে যেন পেয়ে বসল। নির্জন পথ, আলো-আঁধারি দু-পাশে, বড়ো বড়ো মাঠে শেয়ালের আনাগোনা, সব কিছু মিলিয়ে একটা যেন ভূতুড়ে আবহাওয়া। একবার চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়েছে, এমন অন্ধকারে দেখলুম আমার কয়েক হাত দুরে, মাটি থেকে খানিকটা ওপরে, দুটো জ্বলজ্বলে চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। থমকে দাঁড়ালুম। পরমুহূর্তে মেঘ কেটে চাঁদ দেখা দিল, আর চাঁদের আলোয় দেখলুম একটা শেয়াল পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ করছে। অন্ধকার কেটে যেতেই ওটা খ্যাঁক খ্যাঁক করতে করতে ছুটে চলে গেল। আমি এবার দৌড়োতে শুরু করলুম।

‘দিমাদের বাড়ির কাছে যখন পৌঁছোলুম তখন গভীর রাত। মনে আবার সাহস ফিরে এল; যাক আর ভয় নেই, পৌঁছে গেছি। তোমাদের দিমার বাপের বাড়ি অনেকটা জায়গা নিয়ে। মস্ত বড়ো একটা বাগান, সেই বাগানের শেষ মাথায় বাড়িটা। সবটাই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা।

‘আগেই বলেছি, নিশুতি রাত, টুঁ শব্দটি নেই, চারদিকে কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব। দিমাদের বাড়িটাও অন্ধকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে, ভেবেছে কোনো কারণে আমি হয়তো রওনা হতে পারিনি।

‘বাঁশের গেট খুলতেই ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল, আমি চমকে উঠলুম। একটু থেমে, আমি আবার হাঁটতে শুরু করলুম। হঠাৎ একটা পেঁচা বিচ্ছিরিভাবে ডেকে উঠল মাথার ওপর, আর আমি থমকে দাঁড়ালুম; সমস্ত শরীর যেন হিম হয়ে গেল। একটু দূরে একটা পেয়ারা গাছের নীচে সাদা মতো কী যেন একটা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলুম, ওটা বাঁ-হাত দিয়ে পেয়ারা গাছের একটা ডাল ধরে নাড়াচ্ছে। ঠিক তখুনি চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়ল।’

বাবলি দাদুর কোলে ঘন হয়ে বসল, অন্যরাও যতটা সম্ভব এগিয়ে এল কাছে।

‘আমিও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লুম। কে ও! মানুষ না অন্য কিছু? আমার বুকের ভেতরটা যেন লাফাতে শুরু করেছে। আবার মেঘ সরে গেল। এবার চাঁদের আলোয় দেখলুম, যে দাঁড়িয়ে ছিল সে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করেছে। আনন্দে যেমন মানুষ নাচে তেমনি। তারপরই ওটা আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। যে আসছে তার পরনে লাল পেড়ে একটা সাদা শাড়ি। সর্বনাশ! ওটা কি পেতনি? আমাকে একা পেয়ে ঘাড় মটকাতে আসছে! শুনেছিলুম নিশুতি রাতে ওরা নাকি বেরোয়, মানুষের দেখা পেলেই ঘাড় মটকে দেয়। ভীষণ ভয়ে আমার সারা গা বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরতে লাগল। ওই অবস্থায় শুধু একটা কথাই মনে হল, তোমাদের দিমার সঙ্গে এ জন্মে আর বোধ হয় দেখা হবে না।

‘ওটা এগিয়ে আসছে, আরও কাছে। আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু গলা দিয়ে শুধু ঘড় ঘড় একটা শব্দ বেরুল। চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছি যেন নাচতে নাচতে ও এগিয়ে আসছে। পেতনি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না, নয়তো অত রাতে বেরিয়েছে কেন? নিশ্চয়ই মানুষ শিকার পেয়ে আনন্দে নাচছে!

‘হঠাৎ দাঁড়িয়ে পেতনিটা হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকতে লাগল। আমার বুকের ভেতর যেন বরফগলা একটা সরু স্রোত বয়ে গেল। গল্পে পড়েছিলুম ওরা নাকি হাতছানি দিয়ে মানুষকে কাছে ডাকে, তারপরই মটকে দেয় ঘাড়। আমি নড়ছি চড়ছি না দেখে ওটা আরেকটু এগিয়ে এল। এবার স্পষ্ট দেখলুম ও হাসছে, ঝকঝকে দাঁত বার করে হাসছে। ওই দাঁত দিয়েই কি আমার ঘাড়ে কামড় বসাবে?

‘কী করে যে তখনও দাঁড়িয়ে ছিলুম জানি না। পেতনিটা যখন প্রায় খুব কাছে এসে পড়েছে তখুনি আমার ভুল ভাঙল। ও হরি! ওটা পেতনি নয়, তোমাদের দিমা— আমার সামনে দাঁড়িয়ে ফিক ফিক করে হাসছে।’

‘ওমা,’ বাবলি বলে উঠল, ‘দিমাকে তুমি এতক্ষণ পেতনি ভেবে ভয় পাচ্ছিলে! শুনলে তো দিমা, দাদুর কাণ্ড!’

‘কিন্তু দিমা নাচছিল কেন?’ কাকুন বলে উঠল।

‘আরে বুঝলি না দিদিভাই,’ দাদুর মুখ কৌতুকে হাসিতে ভরে যায়, ‘অনেকদিন পর বরকে দেখে আনন্দে নাচছিল তোদের ছোট্ট দিমা।’

‘তুমিই-বা দিমা অত রাত্তিরে বাইরে অমন করে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? দাদু তো ভয় পাবেই,’ টুটুল দাদুর পক্ষ নেয়।

‘হ্যাঁ, দিমা, অত রাত্তিরে কেন দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি?’ প্রশ্ন করল কাকুন, ‘তোমার কি ভয়ডর নেই?’

ওদের দিমা এতক্ষণ পুজো করছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আসনটা ভাঁজ করে তুলে রাখতে রাখতে গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, ‘ভূতের সঙ্গে দেখা হবে বলে দাঁড়িয়ে ছিলুম।’

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments