Monday, May 20, 2024
Homeকিশোর গল্পবিখ্যাত চোরের অ্যাডভেঞ্চার - হেমেন্দ্রকুমার রায়

বিখ্যাত চোরের অ্যাডভেঞ্চার – হেমেন্দ্রকুমার রায়

এক বিশ্ববিখ্যাত চোরের সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি। কিছু কম চারশো বছর আগে বিলাতে এই চোরের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু আজ সারা পৃথিবীর সব দেশই তাকে ঘরের লোকের মতন আদর করে। কেবল আদর নয়, শ্রদ্ধাও করে। আর কোনও চোরই পৃথিবীর কাছ থেকে এত সম্মান, এত ভালোবাসা পায়নি। এই সবচেয়ে বিখ্যাত চোরের নাম তোমাদেরও অজানা নয়। গল্প শুনতে-শুনতে তার নামটি আন্দাজ করো দেখি!

বিলাতের ওয়ারউইকসায়ার বলে একটি জেলা আছে। তার শুকনো বুক ভিজিয়ে বয়ে যায় সুন্দরী অ্যাভন নদী। তারই তীরে চার্লেকোট নামে এক তালুক। জমিদারের নাম, স্যার টমাস লুসি।

মস্ত বড় তালুক–তার মধ্যে গ্রামও আছে, বনও আছে। বনে দিকে দিকে চরে বেড়ায় হরিণের দল। এসব হরিণ, স্যার টমাসের নিজের সম্পত্তির মধ্যে গণ্য। কেউ হরিণ চুরি করলে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। হরিণদের উপরে পাহারা দেওয়ার জন্যে অনেক লোক নিযুক্ত আছে। তবু আজকাল প্রায়ই হরিণের পর হরিণ চুরি যাচ্ছে।

কাজেই স্যার টমাস ভয়ানক খাপ্পা হয়ে উঠেছেন। দেওয়ানকে ডেকে ধমক দিয়ে তিনি বললেন, ব্যাপারখানা কি বলল দেখি? ফিহপ্তায় দেখছি আমার জমিদারি থেকে হরিণ চুরি যাচ্ছে! চোরেরা বাছা-বাছা হরিণ নিয়ে পালায়। এ চুরি বন্ধ করতেই হবে! চারিদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করো! আমার বিশ্বাস, এ-সব এক-আধজন চোরের কীর্তি নয়, এর মধ্যে অনেক লোক আছে!

দেওয়ান ভয়েভয়ে বললে, হুজুর, চারিদিকেই আমি পাহারা বসিয়েছি। এতদিন পরে কালকে একদল চোর প্রায় ধরা পড়তে-পড়তে বেঁচে গিয়েছে! সেপাইরা তাদের পিছনে তাড়া করেছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, কারুকেই ধরতে পারেনি!

স্যার টমাস জিজ্ঞাসা করলেন, কারুর ওপরে কি তোমার সন্দেহ হয় না?

দেওয়ান বললে, গাঁয়ে গিয়ে আমি খোঁজ নিয়েছি। কতকগুলো ছোকরাকে দেখলুম, তারা আপনার নামে যা-খুশি-তাই বলে বেড়ায়! হরিণ-চুরির কথা তুললে তারা আবার মুখ টিপে টিপে হাসে। কিন্তু তাদের মধ্যে কে চোর আর কে সাধু, সে কথা বলা ভারি শক্ত।

স্যার টমাস মুখভঙ্গি করে বললেন, একবার যদি হতভাগ্যাদের ধরতে পারি, তাহলে তাদের কেউ আর মুখ টিপে টিপে হাসবে না! বারবার চুরি! দেওয়ান, এ চুরি বন্ধ করতেই হবে।

হঠাৎ বাইরে একটা গোলমাল উঠল–বাদ-প্রতিবাদ, ধস্তাধস্তি! তারপরেই একজন লোক ঘরের ভিতর ঢুকে সেলাম করে বললে, হুজুর, কাল রাত্রে একটা চোর ধরা পড়েছে!

স্যার টমাস অত্যন্ত আগ্রহে বলে উঠলেন, কোথায় সে বদমাইশ?

অনেক কষ্টে তাকে ধরে এনে কাছারিবাড়ির একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে!

তাকে তুমি চেনো?

না হুজুর! কিন্তু গাঁয়ের সবাই তাকে চেনে। হাড়বখাটে ছোকরা, আরও দু-একবার নাকি অন্যায় কাজ করে ধরা পড়েছে।

কেমন করে তাকে ধরলে?

হরিণটাকে মেরে কাঁধে তুলে সে বনের ভিতর দিয়ে পালাচ্ছিল। সেই সময়ে দেখতে পেয়ে আমাদের লোকেরা তাকে তাড়া করে। তখন যদি হরিণটাকে ফেলে দিয়ে সে পালাত, তাহলে কেউ তাকে ধরতে পারত না।

বিকট আনন্দে স্যার টমাস বললেন, নিয়ে এসো–এখনি তাকে এখানে নিয়ে এসো, পরদ্রব্য চুরি করার মজাটা সে ভোগ করুক! দেওয়ান, তুমি এখন যেতে পারো। কিন্তু সাবধান! মনে রেখো, আরও অনেক চোর আমার বনে বেড়াতে আসে, একে-একে তাদের সবাইকে ধরে দশ ঘাটের জল খাওয়াতে হবে!

স্যার টমাস কেবল জমিদার নন। তিনি পার্লামেন্টের সভ্য, আদালতের বিচারক। কাজেই তাড়াতাড়ি নিজের পদ-মর্যাদার উপযোগী জমকালো পোশাক পরে নিলেন। তারপর খুব ভারিকেচালে পা ফেলে মুখখানা পাচার মতো গম্ভীর করে তুলে প্রকাণ্ড হলঘরের ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন। এইখানে বসেই তিনি জমিদারির কাজকর্ম করেন, প্রজাদের আবেদন-নিবেদন শোনেন, দোষীদের শাস্তি দেন। হরিণ-চোর ধরা পড়েছে শুনে স্যার টমাসের পরিবারের অন্যান্য স্ত্রী পুরুষেরাও মজা দেখবার জন্যে সেখানে এসে জুটলেন।

শোনা গেল, দূর থেকে একটা গোলমাল ক্রমেই বাড়ির কাছে এগিয়ে আসছে। তারপর অনেক লোকের পায়ের শব্দ হল-ঘরের দরজার সামনে এসে থামল। তারপর দুজন পাহারাওয়ালা দুদিক থেকে এক নবীন যুবককে ধরে টানতে-টানতে ঘরের ভিতর এনে হাজির করলে। তার পিছনে আর-একজন লোকের কাছে একটা দিব্য মোটাসোটা মরা হরিণ। আর-একজন লোকের হাতে রয়েছে একটা ধনুক–এই ধনুকেই বাণ জুড়ে চোর হরিণটাকে বধ করেছে। সব-পিছনে আরও একদল লোক, তারাও এসেছে মজা দেখতে। পৃথিবীতে চিরদিনই চোরের শাস্তি দেখা, ভারি একটা মজার ব্যাপার!

চোরের বয়স কুড়ি বছরের মধ্যেই। দেখতে সুপুরুষ, মাথায় ঢেউখেলানো লম্বা চুল, ডাগর-ডাগর চোখ, মুখে কচি গোঁফ-দাড়ির রেখা, মাঝারি আকার। তাকে দেখলে কেউ চোর বলে সন্দেহ করতে পারবে না।

কড়া চালে, চড়া স্বরে স্যার টমাস বললেন, এদিকে এগিয়ে এসো ছোকরা!

চোর এগিয়ে এল।

কি নাম তোমার?

চোর নিজের নাম বললে।

নাম শুনে স্যার টমাসের কিছুমাত্র ভাব-পরিবর্তন হল না। তখন সে নামের কোনওই মূল্য ছিল না, যদিও আজ সে নাম শুনলে বিশ্বের মাথা নত হয়!

দুই চোখ পাকিয়ে স্যার টমাস বললেন, তোমার নামে চুরির অভিযোগ হয়েছে। তোমার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দিয়েছে, তাদের সন্দেহ করবার কোনও উপায় নেই। তুমি বামাল সমেত ধরা পড়েছ। তোমার অপরাধ গুরুতর। কাজেই তোমার দণ্ডও লঘু হবে না। এ-অঞ্চলে তোমার মতন আরও কয়েকজন পাজি চোর-ছ্যাচোড় আছে বলে খবর পেয়েছি। তাই তোমাকে আমি এমন শাস্তি দিতে চাই, যাতে সবাই সময় থাকতে সাবধান হয়।

চোর মৃদু স্বরে বললে, বেশ, আমি জরিমানা দেব।

স্যার টমাস কঠোর কণ্ঠে বললেন, না!

তা হলে আমাকে জেলে পাঠান।

স্যার টমাস কঠোর কণ্ঠে বললেন, না, না! তোমার জরিমানাও হবে না, তোমাকে জেলেও পাঠাব না! তোমার পৃষ্ঠে ত্রিশবার বেত্রাঘাত করা হবে।

বেত্রাঘাত ছিল তখন অত্যন্ত অপমানকর দণ্ড। আসামির মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। এমন দণ্ডের কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি, তাড়াতাড়ি আর্তস্বরে সে বলে উঠল, জরিমানা করুন– জেলে পাঠান, কিন্তু দয়া করে, বেতমারার হুকুম দেবেন না!

স্যার টমাস অটল ভাবে বললেন, আসামিকে নিয়ে যাও এখান থেকে! তার পিঠে সপাসপ ত্রিশ ঘা বেত মারা হোক!

চোরকে সবাই টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। তারপর তাকে সকলকার সামনে এক প্রকাশ্য স্থানে দাঁড় করিয়ে তার দুই হাত বেঁধে, পিঠে বেতের পর বেত মারা হল।

সেদিন রক্তাক্ত দেহে মাথা নীচু করে চোর যখন বাড়িতে ফিরে এল, তখন পিঠের যাতনায় চেয়ে, মনের যাতনাই তাকে বেশি কাবু করে ফেলেছে। প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্যে তার সারা প্রাণ ছটফট করতে লাগল, কিন্তু মহাধনী মহা শক্তিশালী জমিদার স্যার টমাস লুসির বিরুদ্ধে কী প্রতিহিংসা সে নিতে পারে? তার সহায়ও নেই, সম্পদও নেই! আবার কি সে বনে ঢুকে হরিণ চুরি করবে? না, চারিদিকে সতর্ক পাহারা, এবারে ধরা পড়লে অপমানের আর অন্ত থাকবে না!

কিন্তু প্রতিশোধ প্রতিশোধ–যেমন করে তোক প্রতিশোধ নিতেই হবেধনী স্যার টমাসকে বুঝিয়ে দিতেই হবে, গরিবও প্রতিশোধ নিতে পারে। চোর বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। হঠাৎ ছেলেবেলার ইস্কুলের কথা তার মনে পড়ল। ছেলেরা এক দুষ্ট মাস্টারের নামে পদ্য লিখে তাকে প্রায় পাগল করে ছেড়েছিল। হ্যাঁ, প্রতিশোধ নেওয়ার এই একটা সহজ উপায় আছে বটে। কিন্তু সে তো জীবনে কখনও পদ্য লেখেনি। সে তো পদ্য লিখতে জানে না। আচ্ছা, একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি?

চোর কাগজ নিলে, কলম নিলে এবং একমনে স্যার টমাসের নামে পদ্য লিখতে বসল। লিখতে লিখতে সবিস্ময়ে সে আবিষ্কার করলে যে, তার পক্ষে পদ্য লেখা মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়। শেষ পর্যন্ত কবিতাটি যা দাঁড়াল, পাঠ করলে স্যার টমাস যে আহ্লাদে আটখানা হবেন না, এটুকু বুঝে চোরের মন অত্যন্ত পরিতৃপ্ত হল। সমস্ত পদ্যটি এখানে তুলে দেওয়ার সময় নেই, মাত্র কয়েকটি লাইনের নমুনা দেখলেই তোমরা তার কতকটা পরিচয় পাবে।

পার্লামেন্টের সভ্য সে যে,
আদালতের জজ সে হাঁদা,
ঘরের ভেতর জুজুবুড়ো,
বাইরে তাকে দেখায় গাধা।
কান ধরে তার নিয়ে গিয়ে।
গাধীর সঙ্গে দাও-গে বিয়ে—
প্রভৃতি।

আমাদের কবি তখনই তার এই অপূর্ব রচনাটি নিয়ে দৌড়ে গাঁয়ের সঙ্গীদের কাছে হাজির হল এবং সকলকে আগ্রহ ভরে পড়ে শোনালে। কবিতাটি তাদের এত চমৎকার লাগল যে, তখনই তারা মুখস্থ করে ফেললে। তাদের মধ্যে ছিল একজন গাইয়ে, সে আবার সুর দিয়ে কবিতাকে গানের মতন গাইতে আরম্ভ করলে। দুদিন যেতে-না-যেতেই সারা গাঁয়ের লোক মনের আনন্দে উচ্চস্বরে কবিতাটি আওড়াতে বা গাইতে শুরু করে দিলে। সে-অঞ্চলে স্যার টমাসকে কেউ পছন্দ করত না।

কিন্তু এতেও নবীন কবির মনের সাধ মিটল না। কারণ, স্যার টমাস হয়তো স্বকর্ণে এমন মূল্যবান কবিতাটি শ্রবণ করেননি। অতএব সে এক রাত্রে চুপিচুপি গিয়ে জমিদার বাড়ির ফটকের গায়ে কবিতাটি লটকে দিয়ে এল।

পরদিন সকালে ছেলে-মেয়ে-বউ নিয়ে স্যার টমাস খেতে বসেছেন, এমন সময়ে এক চাকর সেই কবিতার কাগজখানা নিয়ে এসে তার হাতে দিয়ে বললে, হুজুর, এখানা ফটকে ঝুলছিল। আমরা পড়তে জানি না, দেখুন তো দরকারি কাগজ কিনা?

স্যার টমাস কাগজখানার উপরে চোখ বুলিয়েই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, হতভাগা, নিশ্চয়ই তুই পড়তে জানিস। কাগজখানা পড়েই আমাকে দেখাতে এসেছিস। দূর হ, বেরো এখান থেকে। চাবকে তোর বিষ ঝেড়ে দেব, জানিস?

চাকর তো এক ছুটে পালিয়ে বাঁচল,সত্যিই সে লেখাপড়া জানত না।

স্যার টমাস একটু ভেবেই চেঁচিয়ে উঠলেন, বুঝেছি, এ সেই পাজির পা-ঝাড়া চোরের কাণ্ড! আমি তার কান কেটে নেব–আমি তার কান কেটে নেব!

চোর-কবির কান অবশ্য কাটা যায়নি, কিন্তু স্যার টমাসের অত্যাচারে তাকে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হল। তবে অনেক বছর পরে আবার যখন গ্রামে ফিরে এল, তখন সে একজন দেশ-বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার।

স্যার টমাস কবে মারা গিয়েছেন। আজ তাকে কেউ চিনত না! কিন্তু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার তাকে নিয়ে প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন বলেই লোকে আজও তাঁর নাম ভোলেনি। চারশ বছর আগেকার সেই হরিণ-চোরের নাম কি তোমরা শুনতে চাও? তিনি উইলিয়ম শেকসপিয়র।

Inspire Literature
Inspire Literaturehttps://www.inspireliterature.com
Read your favourite inspire literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments